ঔপনিবেশিক কৰ্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা
অষ্টম শ্রেণির ইতিহাস
তৃতীয় অধ্যায়
ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাণিজ্য করতে এসেছিল। তাদের ( বাণিজ্যিক স্বার্থে তারা মাদ্রাজ, বোম্বাই ও কলকাতায় তিনটি ঘাঁটি গড়ে তুলে ব্রিটিশ প্রেসিডেন্সি ব্যবস্থা চালু করে। ১৬১১ খ্রিস্টাব্দে মসুলিপটনম ও ১৬১২ খ্রিস্টাব্দে সুরটিকে ঘাঁটি করে ওই ব্রিটিশ বাণিজ্যিক কোম্পানি তাদের বাণিজ্যিক কার্যকলাপ চালিয়ে যায়। ১৬৩১ খ্রিস্টাব্দে বাণিজ্যিক প্রসার ঘটাতে মাদ্রাজে একটি ঘাঁটি তৈরি করে এবং মাদ্রাজপটনম গ্রামে সেন্ট জর্জ দুর্গও তৈরি করে। সেন্ট জর্জ দুর্গ ও মাদ্রাজকে নিয়ে গড়ে ওঠে মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি।
সুরাটে ব্রিটিশ কোম্পানির ঘাঁটি বানানোকে কেন্দ্র করে বোম্বাই প্রেসিডেন্সি তৈরি হয়। বোম্বাই প্রেসিডেন্সির আওতায় ছিল পশ্চিম ও মধ্য ভারত, সিন্ধুপ্রদেশ এবং আরব সাগরের তীরবর্তী অঞ্চলগুলি। ১৬৮৭ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ বোম্বাইকে ঘিরেই ব্রিটিশ কোম্পানি। ভারতে তাদের কার্যকলাপ জোর কদমে চালিয়ে যায়।
ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কলকাতাকে ঘিরে পূর্বভারতে তাদের বাণিজ্যিক কার্যকলাপ সবচেয়ে দ্রুতগতিতে চালিয়ে যাচ্ছিল। ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট ফারুকশিয়রের কাছে বাংলা, বিহার ও ওডিশার দেওয়ানি লাভের ফরমান পেয়ে কলকাতা ব্রিটিশ কোম্পানির অন্যতম প্রধান ঘাঁটি হয়ে ওঠে। ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে নিজামতের অধিকার পেয়ে তারা মুনাফা লুণ্ঠনের চূড়ান্ত অধিকারী হয়ে ওঠে। বাংলা, বিহার, ওডিশা (উড়িষ্যা), অসম ও ত্রিপুরা নিয়ে গঠিত হয় বাংলা প্রেসিডেন্সি।
অষ্টম শ্রেণীর ইতিহাস দ্বিতীয় অধ্যায়
প্রথম দিকে মাদ্রাজ, বোম্বাই ও কলকাতার ঘাঁটিগুলি তিনটি ভিন্ন পরিষদ বা Council (কাউন্সিল)-এর মাধ্যমে পরিচালিত হত। লন্ডনে ব্রিটিশ কোম্পানির যে পরিচালক গোষ্ঠী বা Council of Directors ছিল তাদের একজন সদস্য ওই ঘাঁটির গভর্নর নির্বাচিত হতেন।
একসময় ভারতে ব্রিটিশ কোম্পানির একচেটিয়া কাজ কারবারের ওপর সরাসরি ব্রিটেনের পালার্মেন্টের নিয়ন্ত্রণ বলবৎ হয়। এইরকম দুটি গুরুত্বপূর্ণ আইনের নাম ১৭৭৩ খ্রিস্টাব্দের রেগুলেটিং অ্যাক্ট এবং ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দের ব্রিটেনের তরুণ প্রধানমন্ত্রী উইলিয়ম পিট (William Pitt, the younger) প্রণীত ভারত শাসন আইন।
রেগুলেটিং অ্যাক্ট ও পিট প্রণীত ভারত শাসন আইন :
১৭৮৫ খ্রিস্টাব্দে ১ জানুয়ারি নতুন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইলিয়ম পিট প্রণীত ভারত শাসন আইন অনুসারে স্বতন্ত্র তিনটি প্রেসিডেন্সি মাদ্রাজ, বোম্বাই এবং কলকাতার কার্যকলাপ তদারকির সর্বোচ্চ দায়িত্বে পাঁচ বছরের জন্য থাকবেন কলকাতার গভর্নর জেনারেল। তাঁর অধীনে থাকবেন মাদ্রাজ ও বোম্বাইয়ের গভর্নররা। কলকাতায় বাংলার গভর্নর জেনারেল, থাকার জন্য তখন কলকাতাই ছিল ভারতের রাজধানী। এর ফলে ভারতে ব্রিটিশ কোম্পানির কার্যকলাপের ওপর ব্রিটেনের পার্লামেন্টের নজরদারি নিশ্চিত হল। পিট প্রণীত এই আইন অনুসারে একটি বোর্ড অফ কন্ট্রোল তৈরি করা হয়। ওই বোর্ডকে কোম্পানির সামরিক ও অসামরিক শাসন ও রাজস্ব ব্যবস্থা পরিচালনার সম্পূর্ণ দায়িত্ব দেওয়া হয়। আর ভারতে কোম্পানির সমস্ত প্রশাসনিক কর্তাই গভর্নর জেনারেলের কর্তৃত্ব মেনে চলতে বাধ্য ।
১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে দ্বৈত শাসনব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গভর্নর জেনারেল লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংস সরাসরি শাসনের দায়িত্ব নিয়ে বাংলায় প্রশাসনিক ও বিচারব্যবস্থার সংস্কার করেন। পরবর্তী গভর্নর জেনারেল লর্ড কর্নওয়ালিশও সংস্কারের এই কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।
• লর্ড হেস্টিংস ও লর্ড কর্নওয়ালিশের সংস্কার :
১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংসের উদ্যোগে দেশীয় অভিজাতদের হাত থেকে বিচারব্যবস্থাকে আলাদা করে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির তদারকির মাধ্যমে নতুন বিচারব্যবস্থা চালু হয়। প্রতি জেলাতে একটি দেওয়ানি ও একটি ফৌজদারি আদালত তৈরি হয়। আইনকানুনে মুঘল প্রভাব থাকলেও দেওয়ানি আদালতগুলিতে ইউরোপীয়রাই শীর্ষ দায়িত্বে ছিলেন। আর দেশীয় আইন ব্যাখ্যা করতেন ব্রাহ্মণ পণ্ডিত ও মুসলিম মৌলবিরা। তাঁদের দায়িত্বে থাকতেন একজন করে কাজি ও মুফতি। ১৭৭৩ থেকে ১৭৮১ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংস ও সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতি স্যর এলিজা ইম্পের ইচ্ছায় বিচার ব্যবস্থায় চূড়ান্ত ইউরোপীয়করণ করা হয়।
অষ্টম শ্রেণীর ইতিহাস প্রথম অধ্যায়
* সুপ্রিমকোর্ট ১৭৭৩ খ্রিস্টাব্দের রেগুলেটিং অ্যাক্ট অনুযায়ী ১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দে কলকাতীয় একজন প্রধান বিচারপতি ও তিনজন বিচারপতির দায়িত্বে সুপ্রিমকোর্ট প্রতিষ্ঠা করা হয়। কিন্তু সুপ্রিমকোর্ট প্রায়ই কোম্পানির তৈরি করা আদালতগুলির এখতিয়ারের হস্তক্ষেপ করার জন্য ১৭৮১ খ্রিস্টাব্দে আইন করে সুপ্রিমকোর্টের এখতিয়ার ও ক্ষমতা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়। এরপর থেকে রাজস্ব সংক্রান্ত মামলা কিংবা কোম্পানির গভর্নর ও গভর্নরের কাউন্সিলের কাজকর্ম সুপ্রিমকোর্ট দেখবে না। ১৭৯৭ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার সুপ্রিমকোর্টে বিচারক কমিয়ে দিয়ে তিনজন করে নেওয়া হয়। ১৮০১ খ্রিস্টাব্দে মাদ্রাজে তৈরি হয় নতুন সুপ্রিমকোর্ট। ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দে | বোম্বাইতেও তৈরি হয় নতুন সুপ্রিমকোর্ট। গোটা ভারতে ছিল তিনটি সুপ্রিমকোর্ট।
বিচারের সমতা প্রতিষ্ঠার জন্য লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংসের উদ্যোগে ১১ জন পণ্ডিত হিন্দু আইনগুলির সারসংকলন করেন। ওই সংকলন ইংরেজিতে অনুবাদ করা হলে ইউরোপীয় বিচারকদের আর ভারতীয় সহকারীদের ওপরে বিশেষ নির্ভর করতে হত না। এরপর মুসলমান আইনগুলিরও একটি সংকলন বানানো হয়ে গেলে এদেশে ঔপনিবেশিক বিচারব্যবস্থা কেন্দ্রীভূত ও শৃঙ্খলাবদ্ধ হয়ে গেল।
লর্ড কর্নওয়ালিশ ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে আইনগুলিকে সংহত করে কোড বা বিধিবদ্ধ আইন চালু করলে দেওয়ানি সংক্রান্ত বিচার ও রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব আলাদা করা হয়। জেলা থেকে সদর পর্যন্ত আলাদা বিচারব্যবস্থায় ইউরোপীয়রাই প্রধান বিচারপতি নিযুক্ত হতেন। নিম্ন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চতর আদালতে আবেদন করা যেত। এই বিচারব্যবস্থার সংস্কার বাস্তবে ঔপনিবেশিক বিচার কাঠামো থেকে ভারতীয়দের পুরোপুরি বান দিয়েছিল।
• লর্ড উইলিয়াম বেন্টিংকের সংস্কার :
গভর্নর জেনারেল লর্ড উইলিয়াম বেন্টিংক প্রশাসনিক বার কমাতে চেয়েছিলেন। এলাহাবাদ ও বারাণসী অঞ্চলে ভূমি রাজস্ব সংগ্রহের ব্যাপারে বেন্টিংক মহলওয়ারি বন্দোবস্ত চালু করেন। তাঁর সময়েই ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর ইত্যাদি পদে ভারতীয়দের নিয়োগ করা হয়। তাঁর আমলে কোম্পানিতে কর্মচারী নিয়োগের ব্যাপারে জাতিধর্ম নির্বিশেষে শুধু যোগাতার ওপরেই জোর দেওয়া হত। তাঁর সময়েই কর্নেল স্লিম্যানের নেতৃত্বে উত্তর ও মধ্য ভারতের কুখ্যাত ঠগি দস্যুদের দমন করা হয় এবং স্লিম্যান ঠগি দস্যুদের দমন করেছিলেন।
• ঔপনিবেশিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার বিভিন্ন প্রকরণ:
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইলিয়াম পিট প্রণীত ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দের আইনের ফলে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কার্যকলাপে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। স্বাভাবিক নিয়মে সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশের সম্পদ ব্রিটিশ স্বার্থে পরিচালনের চেষ্টায় কোম্পানি অধিকৃত অঞ্চল সমূহতে একই শাসন চালু হয়। ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কোম্পানি ভারতীয় শাসকের মতো করে শাসনকার্য পরিচালনা করে। এরপর থেকে বিচারব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ ও সেনা ব্যবস্থা এবং আমলাতন্ত্রের মাধ্যমে ঔপনিবেশিক শাসনতন্ত্র এদেশে প্রতিষ্ঠিত হয়।
• পুলিশ ব্যবস্থা :
মুঘল বাদশাহের কাছ থেকে দেওয়ানি লাভ করে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মুঘলদের পুলিশ ব্যবস্থার মতো ফৌজদার, কোতোয়াল ও চৌকিদারি রেখেছিল দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার ব্যাপারে। কিন্তু ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় মর্মান্তিক ছিয়াত্তরের মন্বন্তরে দেশের শাস্তিশৃঙ্খলার চরম অবনতি দেখা দেয়। ফলে উপনিবেশিক শাসনের সুবিধার্থে ১৭৮১ খ্রিস্টাব্দে পুরোনো ফৌজদারের জায়গায় ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করা হয়।
লর্ড কর্নওয়ালিশ ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে জেলাগুলির দেখভাল করার জন্য পুলিশ থানা চালু করে দারোগার ওপর থানার দায়িত্ব অর্পণ করেন। ম্যাজিস্ট্রেটের অধীনে দারোগারা স্থানীয় সাধারণ মানুষদের কাছে কোম্পানি শাসনের শীর্ষকর্তা ছিল। এই দারোগারা স্থানীয় জমিদারদের সঙ্গে সমঝোতা করে চলত বলে সাধারণ মানুষ দারোগা ও জমিদারের যৌথ পীড়ন সহ্য করত। তাই এর বদলে দারোগার পরিবর্তে গ্রামের দেখভাল কালেক্টরের ওপর দিলেও তা উপনিবেশিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার উপযোগী করা সম্ভব হয়নি। শেষ পর্যন্ত কোম্পানির আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে ১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দে সিন্ধুপ্রদেশ অঞ্চলে নতুন ধাঁচের পুলিশি ব্যবস্থা প্রয়োগ করে আলাদা পুলিশ আইন তৈরি করা হয়। এই পুলিশি ব্যবস্থাই হয়ে উঠল ঔপনিবেশিক কৰ্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা ও প্রদর্শনের অন্যতম হাতিয়ার। সেনাবাহিনী : ঔপনিবেশিক শাসনের যে-কোনো বিরোধিতার মূলোৎপাটন করতে প্রাথমিকভাবে পুলিশি ব্যবস্থা কার্যকরী থাকলেও ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য ছড়িয়ে পড়তে থাকার সঙ্গে সঙ্গে কোম্পানি ভারতীয় সেনাবাহিনী গড়ে তোলে। এরপর কোম্পানির রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রসারিত হলে সামরিক খাতে উপনিবেশিক শাসক সবচেয়ে বেশি খরচ করত। বিভিন্ন বিদ্রোহের মোকাবিলা করতে এবং কোম্পানির নতুন নতুন এলাকা দখল করতে সাহায্য করত এই সিপাহিরা।
ঔপনিবেশিক শাসনের গোড়ার দিকে সেনাবাহিনীতে জাতিভিত্তিক মনোভাব প্রদর্শনের জন্য উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণ ও রাজপুত কৃষকরা সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে অনেক বেশি সুযোগ-সুবিধা ও নিয়মিত বেতন লাভের সুযোগ লাভ করত। কিন্তু ১৮২০-র দশক থেকে সেনাবাহিনীতে মারাঠা, মহীশুর অঞ্চলের পাহাড়ি উপজাতি ও নেপালি গোর্খাদের নিয়োগ করা হয়। ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দের দশকে মোট রাজস্বের ৪০ শতাংশ অর্থ সেনাবাহিনীতে নিযুক্ত প্রায় আড়াই লক্ষ সিপাহির জন্য ব্রিটিশ কোম্পানি খরচ করত।
সামরিক জাতি। ব্রিটিশ শাসকরা মনে করত ভাত খাওয়া ভারতীয়রা শারীরিকভাবে দুর্বল এবং রুটি খাওয়া ভারতীয়রা শক্তিমান। সেই বিচারে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের সিপাহি বিদ্রোহের পর থেকেই পঞ্চাবের জাঠ অধিবাসী, পাঠান, উত্তর ভারতের রাজপুত ও নেপালি গোণাদের সংখ্যা সেনাবাহিনীতে বৃদ্ধি করা হয়। ঔপনিবেশিক শাসকরা এদের যুদ্ধ পারদর্শী বিচার করে এদের 'সামরিক জাতি' বলে প্রচার করত। এর বদলে ওই সিপাহিরা ব্রিটিশ শাসনের প্রতি অনুগত থাকত। ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে ঔপনিবেশিক সেনার ।
আমলাতন্ত্র :
ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থায় অসামরিক ক্ষেত্রে আমলারাই ছিল শাসকের প্রধান অস্ত্র। তাই লর্ড কর্নওয়ালিশ প্রবর্তিত আমলাতন্ত্র তৈরি করতে সিভিল সার্ভিস বা অসামরিক প্রশাসন ব্যবস্থা চালু করেন। কর্নওয়ালিশ মনে করতেন উপযুক্ত বেতন না পাওয়ার জন্য কোম্পানির কর্মচারীরা সততা ও দক্ষতার সঙ্গে কাজ করেন না। তাই তিনি প্রশাসনের কর্মচারীদের বেতন বাড়িয়ে দেন এবং কোম্পানির প্রশাসনের আধিকারিকদের ব্যক্তিগত ব্যাবসা ও কোনো প্রকার উপহার গ্রহণ বন্ধ করে দেন।
১৮০০ খ্রিস্টাব্দে লর্ড কর্নওয়ালিশ সিভিল সার্ভেন্ট বা অসামরিক প্রশাসকের শিক্ষালাভের জন্য কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ স্থাপন করেন। কিন্তু ব্রিটেনে কোম্পানির পরিচালকরা কলকাতায় প্রশিক্ষণের বদলে ব্রিটেনে প্রশিক্ষণকেই উপযুক্ত মনে করতেন বলে শেষ পর্যন্ত হেইলবেরি কলেজে প্রশিক্ষণের প্রক্রিয়া শুরু হয়। একই কলেজে পড়ার ফলে সিভিল সার্ভেন্টরা নিজেদের একটি ভিন্ন গোষ্ঠী মনে করতে থাকে। তাদের মধ্যে ওই ঐক্যভাবনা ঔপনিবেশিক প্রশাসনের পক্ষে অত্যন্ত শুভ হয়েছিল।
+ আইনের শাসন ও আইনের চোখে সমতা :
ঔপনিবেশিক শাসক হিসেবে ব্রিটিশ প্রশাসন ভারতে আইনের শাসনের ধারণা চালু করেছিল। সেই ধারণা স্পষ্ট করতে আইনে শাসক ও জমিদাররা সমস্ত অধিকার স্পষ্ট ব্যাখ্যা করা থাকবে। অর্থাৎ এখানে গণতান্ত্রিক প্রশাসনের কথাই বলা হয়েছিল। কিন্তু কার্যত শাসকের স্বার্থ সুরক্ষার উদ্দেশ্যেই আদালতের দেওয়া আইনের ব্যাখ্যা অনুযায়ী ঔপনিবেশিক প্রশাসন কাজ করত। আবার জাতিধর্মবর্ণশ্রেণিনির্বিশেষে একই আইনের কথা বলা হলেও ইউরোপীয় ব্যক্তিদের বিচারের জন্য আলাদা আইন ও আদালত গঠিত হয়েছিল। বাস্তবে আইন-আদালতকেন্দ্রিক বিচারকাব্য হয়ে পড়েছিল।
• নতুন শিক্ষা :
ওয়ারেন হেস্টিংস ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির স্বার্থরক্ষার্থে ফারসি ভাষা ও ভারতীয় অন্যান্য ভাষা জানা লোকদের রাজস্ব দফতরে নিয়োগ করেছিলেন। তিনি হিন্দু ও মুসলিম আইনগুলিকে ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করিয়ে কোম্পানির কর্মচারীদের সুবিধা করে দিয়েছিলেন। কোম্পানির বিভিন্ন নিয়মনীতিকে বিভিন্না ভারতীয় ভাষায় অনুবাদ করিয়েছিলেন। ১৭৮৩ খ্রিস্টাব্দে জোনাথন ডানকান সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতি স্যার এলিজা ইম্পের প্রণীত আইনগুলির ফারসি ও বাংলায় অনুবাদ করে দিয়েছিলেন। জোনাথন ডানকান শিক্ষিত ব্যক্তিদের ঔপনিবেশিক শাসন ও বিচারব্যবস্থায় সুগঠিত করার উদ্দেশ্যে ১৭৯১ খ্রিস্টাব্দে বেনারসে হিন্দু কলেজ গড়ে তুলেছিলেন। তারও দশ বছর আগে অবশ্য ১৭৮১ খ্রিস্টাব্দে প্রায় একই উদ্দেশ্যে আরবি ও ফারসি ভাষা চর্চার জন্য লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংস কলকাতায় মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। শিক্ষাব্যবস্থার এই উদ্যোগে ওয়ারেন হেস্টিংসকে জোনাথন ডানকান ছাড়াও চার্লস উইলকিনসন এবং নাথানিয়েল ব্রাসি হ্যালেন সহযোগিতা করেছিলেন।
* মুদ্রিত বাংলা বই লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংসের উদ্যোগে নির্মিত হিন্দু আইন সংকলনটি ব্র্যাসি হ্যালের ইংরেজিতে অনুবাদ করে তার সংক্ষিপ্ত নাম নিলেন A Code of Gentoo Law. ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি A Grammar of the Bengal Language নামে একটি বাংলা ব্যাকরণও রচনা করেছিলেন। ওই বইটি প্রথম বিচল | বাংলা হরফ ব্যবহার করে হুগলির জন অ্যান্ড্রুজ-এর ছাপাখানায় ছাপা হয়। তবে জোনাথন ডানকান ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে বাংলা ভাষায় প্রথম যে পূর্ণাঙ্গা আইনের বইটি রচনা করেন তার নাম মপসল দেওয়ানি আদালত সকলের ও সদর দেওয়ানি আদালতের বিচার ও ইনসাফ চলা হইবার কারণ ধারা ও নিয়ম।
উইলিয়াম কেরি ও ব্যাপটিস্ট মিশন ঃঃ
১৮০০ খ্রিস্টাব্দে ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। ব্রিটিশ কোম্পানির শিক্ষাবিস্তারে সহায়তা করতে শ্রীরামপুরের মিশনারিরা ব্যাপটিস্ট মিশন স্থাপন করে নিজেদের কোনো মুদ্রণযন্ত্রে বাংলা ভাষায়
বিভিন্ন বই ছাপা শুরু করেন। শ্রীরামপুর মিশনের উইলিয়াম কেরি ভারতীয় মহাকাব্যগুলি ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করেন। তিনি ভারতীয় বিভিন্ন ভাষার বাইবেলের | একটি অংশও অনুবাদ করেন। ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে হ্যালেদের লেখা বাংলা ব্যাকরণ। বইটিও সম্পাদনা করে প্রকাশ করেন তিনি।
১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে উইলিয়ম জোনস কলকাতায় এশিয়াটিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি সংস্কৃত ভাষায় লেখা প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যগুলি ইংরেজিতে অনুবাদ করে ভারতের শিক্ষিত মানুষদের সঙ্গে ব্রিটিশদের বোঝাপড়া সুখম ও সুগম করতে চেয়েছিলেন। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে এশিয়াটিক সোসাইটির বিভিন্ন সদস্য, শ্রীরামপুর মিশনের উইলিয়াম কেরি এবং স্থানীয় পণ্ডিতদের ওই কলেজে নিয়োগ করেছিলেন।
স্কটিশ মিশনারি সোসাইটির সদস্য আলেকজান্ডার ডাফ ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় এসে অনেকগুলি মিশনারি স্কুল স্থাপন করেন। ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে তারই প্রতিষ্ঠিত জেনারেল অ্যাসেম্বলি ইন্সটিউশনটি সবথেকে বিখ্যাত। সংস্কৃত সাহিত্যের চর্চার পাশাপাশি পাশ্চাত্য বিকাশ ঘটানোর চেষ্টায় ১৮২১ খ্রিস্টাব্দে সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত হেম্যান হোরাস উইলসন কলকাতায় সংস্কৃত কলেজের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেন।
১৮২৩ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত জেনারেল কমিটি অভ্র পাবলিক ইন্সট্রাকশন-এর উদ্যোগেও আরও দুটি সংস্কৃত কলেজ ও একটি মাদ্রাসা তৈরির কথা বলা হয়। ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতি স্যার এডওয়ার্ড হাইড ইস্ট এবং ডেভিড হেয়ারের উদ্যোগে কলকাতায় হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। রাজা রামমোহন রায়ও হিন্দু কলেজের কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তবে ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দে রামমোহন লর্ড আমহার্স্টকে একটি চিঠিতে সংস্কৃত শিক্ষা ও সংস্কৃত কলেজ প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেন।
১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে ইংরেজি ভাষা-নির্ভর পাশ্চাত্য শিক্ষার দ্রুত বিস্তার ঘটতে থাকে। ১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দে একটি প্রতিবেদনে সরাসরি বলা হয় ইংরেজি শিক্ষার বিস্তারে প্রশাসন জোর দেবে বেশি। এ ছাড়া দেশীয় ভাষাতেও পড়াশোনা করার জন্য অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে সরকারি অনুদান দেওয়া হবে। ১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দে সরকারি চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে ইংরেজি ভাষাজ্ঞানকে আবশ্যক ঘোষণা করে। ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দের ২ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত লর্ড মেকলের প্রতিবেদন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
মেকলের প্রতিবেদন :
জেনারেল কমিটি অভ পাবলিক ইনস্ট্রাকশনের সভাপতি টমাস ব্যারিংটন নেকলে ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দের ২ ফেব্রুয়ারি একটি প্রতিবেদন করেন, ভারতবর্ষে ইংরেজি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি তৈরি করাই ঔপনিবেশিক শাসনের প্রধান | উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। ওই প্রতিবেদনে তিনি আরও বলেন যেসব প্রতিষ্ঠানে ভারতীয় ভাষা চর্চিত হবে তাদের সরকারি অনুদান দেওয়া হবে না। তিনি সংস্কৃত কলেজেরও বিলুপ্তির পক্ষে সওয়াল করেছিলেন। তিনি মনে করতেন জাতিগতভাবে উন্নত ব্রিটিশদের হাত ধরেই ভারতে আধুনিকতা আসবে। এভাবে মেকালে ভারতে প্রচলিত জ্ঞানচর্চাকে হেয় করেছিলেন।
১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় কাউন্সিল অভ এডুকেশনের চেষ্টায় ঊনবিংশ শতকের চারের ও পাঁচের দশকে সরকারি অনুদানে শিক্ষার যথেষ্ট বিকাশ ঘটে। তবে শিক্ষাখাতে যে সরকারি ব্যয় বরাদ্দ হয়েছিল তা প্রয়োজনের তুলনায় কম ছিল।
উডের প্রতিবেদন :
১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে বোর্ড অত কন্ট্রোলের | সভাপতি চার্লস উডের শিক্ষা সংক্রান্ত প্রতিবেদনটিকে বলা হয় উডস ডেসপ্যাচ। তাঁর পরামর্শ অনুযায়ী সরকার ইংরেজি ও ভারতীয় দুই ধরনের ভাষা চর্চায় লক্ষ্যে দেশে অনেক প্রাথমিক বিদ্যালয় ও উচ্চবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে তিনটি প্রেসিডেন্সিতে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। এ ছাড়া অনেকগুলি নতুন প্রাথমিক ও উচ্চবিদ্যালয় খোলা হয়।
বোম্বাই প্রেসিডেন্সিতে শুরু থেকেই অবশ্য ভারতীয় ভাষার মাধ্যমে পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চায় জোর পড়েছিল। ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ বোম্বাই প্রেসিডেন্সির অসংখ্য স্কুলেই মাতৃভাষায় শিক্ষাদান করা হত। খ্রিস্টান মিশনারিদের উদ্যোগে মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সিতে শিক্ষার প্রসার ঘটেছিল। ব্রিটিশ কোম্পানির উদ্দেশ্যেই ছিল শিক্ষাবিস্তারের নামে সমাজের কিছু মানুষকে শিক্ষিত করে ঔপনিবেশিক প্রশাসনিক কাঠামোর সংযুক্ত করে নেওয়া। উচ্চশিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ইংরেজি ভাষাকে নির্দিষ্ট করে দেওয়ার জন্য শিক্ষাবিস্তার গণমুখী হয়নি। এ ছাড়া উপযুক্ত প্রায়োগিক প্রশিক্ষণ বা হাতেকলমে শেখার উপযুক্ত ব্যবস্থা না থাকায় দেশে কেবল পুঁথিগত শিক্ষারই বিস্তার ঘটেছিল। ঔপনিবেশিক শিক্ষানীতিতে প্রথম দিকে নারীশিক্ষার প্রতিও জোর দেওয়া হয়নি। কয়েকজনের ব্যক্তিগত উদ্যোগে নারীশিক্ষার বিস্তার শুরু হয়। এই উদ্দেশ্যে বেথুন সাহেবের উদ্যোগে কলকাতায় হেদুয়া অঞ্চলে মেয়েদের জন্য বাটন (বেথুন) স্কুল তৈরি হয়।
জমি জরিপ ও রাজস্ব নির্ণয় :
১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে পলাশির যুদ্ধের পর বাংলার নতুন নবার মিরজাফর ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে ২৪টি গ্রামের জমিদারি পাইয়ে দেন। ফলে কোম্পানির কর্তা লর্ড ক্লাইভ ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দে ফ্রাংকল্যান্ড নামক এক সার্ভেয়ারকে দিয়ে কলকাতা থেকে কুলপি পর্যন্ত জমি জরিপের কাজ শুরু করেন। তবে জরিপের কাজ শেষ হওয়ার আগেই ফ্রাংকল্যান্ড মারা গেলে ওই কাজ হম্ ক্যামেরন সম্পূর্ণ করেন। | ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে বাংলার নদীপথগুলি জরিপ করে মোট ১৬টি মানচিত্র সেই প্রথম তৈরি করেছিলেন জেমস রেনেল। ১৭৬৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি ব্রিটিশ কোম্পানির ভারতের সার্ভেয়ার জেনারেল বা জরিপ বিভাগের প্রধান হিসেবে নিয়োজিত হন.
- ইজারাদারি অস্থা ও বাংলা প্রেসিডেন্সির ভূমি-কাজস্ব বন্দোবস্ত নিয়ে ব্রিটিশ কোম্পানি নিলামে সবচেয়ে বেশি ডাক দেওয়া ব্যক্তিকে জমি বিলি করত। পরের বছরে মাত্র এক বছরের জন্য জমি নিলাম দিত। ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংস নদিয়া জেলায় নতুন ভূমি রাজস্ব বন্দোবস্ত চালু করে সবচেয়ে বেশি খাজনা প্রদানকারী ব্যক্তিকে জমি দিতে আরম্ভ করলেন। পাঁচ বছরের জন্য ইজারাদারি বন্দোবস্তকে বলা হত পাঁচশালা বন্দোবস্ত।
১৭৬৪ খ্রিস্টাব্দে বক্সারের যুদ্ধের শেষে দেওয়ানি লাভের পর কোম্পানি জমি জরিপ করে রাজস্ব নির্ণয়ে তৎপর হয়ে ওঠে। ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দে মুরশিদাবাদে কম্পট্রোলিং কাউন্সিল অভ রেভিনিউ নামে একটি কমিটি গঠিত হয়। এ ছাড়া কমিটি অভ রেভিনিউ নামেও আলাদা একটি বোর্ড গঠন করা হয়। ১৭৮৬ খ্রিস্টাব্দে অবশ্য ওই কমিটির নাম বদলে বোর্ড অভ রেভিনিউ রাখা হয়।
ইজারাদারি বন্দোবস্তে অনেক ইজারাদারই গ্রামসমাজের বাইরের লোক হওয়ায় জমির ধার্য রাজস্ব ঠিকমতো শেষ করতে পারেননি। তাই কোম্পানি ১৭৯০ খ্রিস্টাব্দে দশসালা বন্দোবস্ত চালু করেন। কিন্তু লর্ড কর্নওয়ালিশ শেষ পর্যন্ত ওইসব ইজারাদারি বন্ধ করে দিয়ে একেবারে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু করে দেন।