WhatsApp Group Join Now
Telegram Group Join Now

ঔপনিবেশিক অর্থনীতির চরিত্র | অষ্টম শ্রেণীর ইতিহাস | চতুর্থ অধ্যায়

বাংলার বুকে ১৭৬৯-৭০ খ্রিস্টাব্দে ভয়ংকর 'ছিয়াত্তরের মন্বন্তর' ঘটে যাওয়ায় কোম্পানির শাসনকর্তা ওয়ারেন হেস্টিংস ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে রাজস্ব আদায়ের জন্য

ঔপনিবেশিক অর্থনীতির চরিত্র

অষ্টম শ্রেণীর ইতিহাস 

চতুর্থ অধ্যায় 

বাংলার বুকে ১৭৬৯-৭০ খ্রিস্টাব্দে ভয়ংকর 'ছিয়াত্তরের মন্বন্তর' ঘটে যাওয়ায় কোম্পানির শাসনকর্তা ওয়ারেন হেস্টিংস ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে রাজস্ব আদায়ের জন্য ইজারাদার ব্যবস্থা চালু করেন। কিন্তু তাতেও কৃষক সমাজে চূড়ান্ত সংকট দেখা দেওয়ায় ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে লর্ড কর্নওয়ালিশ রাজস্ব আদায় সংক্রান্ত নতুন উদ্যোগ নেন।


• চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত :

 রাজস্ব আদায়ের গলদপূর্ণ পদ্ধতিতে কৃষক সমাজে যেমন ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছিল তেমনই কোম্পানিও যথেষ্ট লাভবান হচ্ছিল না। এই সমস্যা দূরীকরণে কোম্পানির অধিকাংশ আধিকারিকের পরামর্শে ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে বাংলার রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু করা হয়। লর্ড কর্নওয়ালিশ চিন্তা করেছিলেন জমিদারদের সম্পত্তির অধিকারকে স্থায়ী ও নিরাপদ করা হলে তাঁরা কৃষির উন্নয়নে অর্থ নিয়োগ করবেন। জমিদাররাও কোম্পানির অনুগত গোষ্ঠী হয়ে পড়বে। তাই তিনি চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু করে বাংলা, বিহার ও ওডিশার সমস্ত জমি জমিদারদের হাতে তুলে দেন। জমি বংশক্রমে জমিদারদের হাতে চলে যায়। এই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে জমিদাররা ক্রমাগত বিশাল ধনবান হয়ে উঠল আর কৃষক সম্প্রদায় হয়ে উঠল প্রায় পথের ভিখারি। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের আগেও জমির ওপর কৃষকদের কিছু অধিকার ছিল। কিন্তু চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে কৃষক শুধুমাত্র ভূমিস্বত্ব প্রজায় পরিণত হল।


এই বন্দোবস্তে উঁচু হারে রাজস্ব আদায় করতে গিয়েও কৃষক সমস্যায় পড়েছিল। এ ছাড়া জমিদাররা যথাসময়ে রাজস্ব দিতে না পারলে জমিদারদের জমি উঠত নিলামে। বাস্তবে, এই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে ভারতীয় সমাজ ও অর্থনীতিতে ব্রিটিশ কোম্পানির কর্তৃত্বই চূড়ান্ত প্রতিষ্ঠিত হয়।


* সূর্যাস্ত আইন :

 আপাতদৃষ্টিতে কোম্পানি সমস্ত জমির মালিকানা জমিদারদের হাতে তুলে দিলেও নির্দিষ্ট সময়ে নির্ধারিত রাজস্ব দিতে না পারলে জমিদারের জমি কোম্পানি কেড়ে নিত। নির্দিষ্ট তারিখে সূর্য অস্ত যাওয়ার আগে রাজস্ব জমা না দিলে কোম্পানি সেই জমি অনাকে বিক্রি করে নিত। এই আইন সূর্যাস্ত আইন নামে সুপরিচিত।

 • চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রভাব : 

বঙ্কিমচন্দ্রের সমালোচনা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কারণে বাংলার কৃষকের যে করুণ পরিণতি দেখা দিয়েছিল তার সমালোচনা করে সাহিত সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছিলেন যে, জীবের শত্রু জীব, মানুষের শত্রু মানুষ, বাঙালি কৃষকের শত্রু বাঙালি ভূস্বামী। জমিদার নামক বড়ো মানুষ কৃষক নামে ছোটো মানুষকে যায়। কর্নওয়ালিশ প্রজাদের হাত-পা বেঁধে জমিদারের গ্লাসে ফেলে দিলেন। কিন্তু জমিদারের হাতে কৃষকের যাতে কোনো অনিষ্ট না হয় তার জন্য কোনো আইন করে দিলেন না। শুধু বললেন যে, পরবর্তী সময়ে জমিদার ও প্রজা সম্পর্কিত বিপজ্জনক সমস্যা দেখা দিলে বিধিবদ্ধ আইন করাবেন। কিন্তু তা আর হল না। জমিদারের হাতে কৃষকরা পুরুষানুক্রমে (মারাত্মক উৎপীড়িত হতে লাগল। ইংরেজরা কিছুই করালেন না।


• রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত 

 ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম ভারত অধিকার করে ভূমি-রাজস্বের বন্দোবস্ত সরাসরি কৃষকের মধ্যেই করেছিল। সেক্ষেত্রে কোম্পানির প্রাপ্য রাজস্ব জমিদারদের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার দরকার হত না। একে বলা হত রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত। রায়ত অর্থে কৃষক। উনিশ শতকের শুরুর দিকে মাদ্রাজ ও বোম্বাইয়ের কিছু অংশে রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত চালু করা হয়। এর ফলে কৃষকরা উপনিবেশিক শাসকের ভাড়াটে চাষিতে পরিণত হয়। কৃষক সময় মতো রাজস্ব দিতে না পারলে সেই জমি কোড়ে নিয়ে অন্য কৃষককে দিয়ে দেওয়া হত। খাজনার পরিমাণও ছিল উঁচু। কোথাও আবার মোট উৎপাদনের ৪৫ থেকে ৫৫ ভাগ খাজনা আদায় করা হত। প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসল নষ্ট হলেও খাজনার পরিমাণ একই দিতে হত।


● মহলওয়ারি ব্যবস্থা 

গ্রামের সমষ্টিকে বলা হয় মহল। ঔপনিবেশিক সরকার মহলওয়ারি বন্দোবস্তের মাধ্যমে উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম ভারতের বিস্তৃত এলাকার মহলের জমিদার বা প্রধানের কাছ থেকে ভূমি রাজস্ব আদায় করে। ফলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মহাজন ও ব্যবসায়ীদের হাতে জমিগুলি কেন্দ্রীভূত হওয়ায় কৃষকরা অত্যাচারিত হতে লাগল।


ভারতীয় সমাজে ব্রিটিশ রাজস্ব নীতির প্রভাব : উনিশ শতকের মাঝামাঝি নাগাদ রাজস্ব আদায়ের এই তিন প্রকার উপায় অবলম্বন করত। বাংলায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম ভারতে রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত এবং উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম ভারতে মহলওয়ারি বন্দোবস্ত ছিল ঔপনিবেশিক শাসকের রাজস্ব আদায়ের পদ্ধতি। তিনটি অলেই ওই তিন রকম বন্দোবস্তের নানা হেরফের থাকলেও ব্রিটিশ কোম্পানি শাসনের ভূমি-রাজস্ব ব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্য ছিল যত বেশি সম্ভব রাজস্ব আদায় করা। ফলে কৃষকের ঘরে র্ভিক্ষ ও দারিদ্র্য নিত্যসঙ্গী হয়েছিল। ঔপনিবেশিক প্রশাসন কৃষকের দুর্দশার মোচনের উপায় কোনোদিনই ভাবেনি। জমিদাররাও কৃষকদের জীবনযাপনের সামান্যতম উন্নয়নের চিন্তা করা তো দূরে থাকা কৃষকদের ওপর নিয়মিত শোষণ ও নিপীড়ন প্রক্রিয়া চালিয়েই যেত। তাঁদের মনোযোগ ছিল কেবলমাত্র রাজস্ব আদায়ের প্রতি।


বাংলার কৃষকদের দুরবস্থা ও অক্ষয়কুমার দত্ত-র আলোচনা :

 বিখ্যাত প্রাবন্ধিক অক্ষয়কুমার দত্ত বাংলার কৃষকদের চরম দুর্দশার বর্ণনা দিতে গিয়ো বলেছেন, যে রক্ষক তাই ভক্ষক'-এ প্রবাদ বুঝি বাংলার ভূস্বামীদের ব্যবহার দৃষ্টেই সূচিত হ্যা। ভূস্বামী নির্দিষ্ট রাজস্ব আদান সংগ্রহ করার পরেও ছলেবলে কৌশলে কী প্রকারে কৃষকের | যথাসর্বস্ব গ্রাস করবে এই আশঙ্কায় কৃষকের নিদ্রাহীন রাত কেটে যেত। কৃয়াকের শুভ শরীর, ছেঁড়া-ময়লা পোশাক দেখেও ভূস্বামী অর্থাৎ জমিদারের হৃদয় একবিন্দু দয়া তো দূরের কথা রাজস্বের বাধা, বাধার বৃদ্ধি, বৃদ্ধির বৃদি, আগমনি, পানী, হিসাবানা ইত্যাদি বলপূর্বক নিয়মিত আদায় করা চলত। এ ছাড়া নায়ের আর গোমস্তার জমিদারের নির্দিষ্ট রাজস্ব আদায়ের আগেই নানা প্রলোভনে তাদের নিজস্ব পাওনা হিসেবে কৃষকের যাবতীয় ধনসম্পদ বলপূর্বক হরণ করে নিত।


মহাজনি ব্যবস্থা : 

অধিক হারে নগদ রাজস্বের দাবি মেটাতে গিয়ে ঔপনিবেশিক আমলের কৃষকেরা আবার মহাজন নামক এক ভয়ংকর জালিয়াতের খপ্পড়ে পড়ে যেতে বাধ্য হত। তারা কৃষকদের অজ্ঞতা ও নিরক্ষরতার সুযোগ নিয়ে একসময় নানা প্রলোভনে কোম্পানির আইনের মাধ্যমে তাদের জমি দখল নিয়ে নিত। এভাবে নিঃস্ব হয়ে যাওয়া কৃষকরা একসময় দলবদ্ধ হয়ে মহাজনদের ওপর আক্রমণ শুরু করল।


• কৃষির বাণিজ্যিক ৰূপায়ণ 

ঔপনিবেশিক সরকারের বাণিজ্যের কাজে প্রয়োজনীয় চা, পার্ট, নীল, তুলো ইত্যাদি ফসল চাষ করতেও নিরীহ কৃষকরা বাধ্য হত। রেলপথ বানানো, রফতানি- হার বৃদ্ধি করা, কৃষির বাণিজিকীকরণকে ব্যাখ্যা করা হত অর্থনীতির আধুনিকীকরণ নামে। এভাবে আধুনিকীকরণের নামে ঔপনিবেশিক সরকার কিন্তু এদেশের কৃষি ব্যবস্থার উন্নতির এতটুকু চিন্তা করেনি। শুধুমাত্র অপেক্ষাকৃত ধনবান কৃষকদের উন্নতির স্বার্থে সামান্য কিছু এলাকায় সেচ ব্যবস্থার জন্য খাল খনন করেছিল। তা ছাড়া জনসংখ্যা বৃদ্ধির তুলনায় ঔপনিবেশিক প্রশাসন কৃষিকে কোনো উন্নতি সাধনের চেষ্টা করা হয়নি বলে ভারতে দুর্ভিক্ষ প্রায় চিরসঙ্গীই হয়েছিল।


কৃষির বাণিজ্যিকীকরণের ফলে ভারতীয় কৃষক সমাজে পারস্পরিক ক্ষুদ্র-বৃহৎ ভারতমা তৈরি করা হয়েছিল। যেসব অঞ্চলে কৃষির সামান্য উন্নতি দেখা গেছে সেখানে মূলধন বিনিয়োগকারীরাই মোটা টাকা মুনাফা করে নিয়ে কৃষকদের দূরবস্থা একই করে রেখে নিত। যেমন ঔপনিবেশিক সরকারের বাণিজ্যিকীকরণের প্রয়োজনে এভাবে মূলধন বিনিয়োগকারীরা পূর্বভারতের বাংলায় অগ্রিম টাকা বা দাদন দিয়ে কৃষকদের নীলচাষ করতে বাধ্য করত। এভাবে নিষ্ঠুরভাবে অত্যাচারিত কৃষকরা বাংলার অনেক অঞ্চলেই। নীলকর ও কোম্পানির বিরুদ্ধে অনিবার্য সংঘর্ষের পথ বেছে নিয়েছিল।

 উত্তর : আমার স্বাধীন অনলে ধান, গম, পাট, বাদাম, সরিষা, তিল, আলু এবং শাকসবজি চাষ হয়। এগুলির মধ্যে খাদ্যশস্য হল ধান, গম, সরিষা, বাদাম, তিল, আলু এবং শাকসবজি। এগুলি আমাদের এলাকায় যেসব কৃষকের ঘরে কিছু কিছু উত্ত হ্যাঁ তারা সেগুলি ব্যাবসাদারদের কাজে বিক্রি করে দেয়। এ ছাড়া পাট একটি মূল্যবান বাণিজ্যিক ফসল। যদিও এই ফসল তেমন একটা লাভজনক নয়।


* বাগিচা শিল্প :

 চা এবং কফি হল বাগিচা শিল্প। খুবই লাভজনক এই ব্যাবসাগুলিকে ঔপনিবেশিক সরকার কর ছাড় দিয়ে বিদেশি মালিকানাধীন করে রেখেছিল। ঊনবিংশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে অসম, বাংলা, দক্ষিণ ভারত ও হিমাচল প্রদেশের পাহাড়ি অঞ্চলে চা-বাগিচা শিল্পের বিকাশ ঘটেছিল। দক্ষিণ ভারতে কফি বাগিচাও ব্যাপক ভাবে বেড়ে উঠেছিল। তবে ওইসব শিল্পের বিকাশে এদেশের জনগণ কিছুমাত্র উপকৃত হয়নি। ওই শিল্পের যাবতীয় মুনাফা বিদেশি কর্মচারীরাই ভোগ করত।


ঔপনিবেশিক শাসনে ভারতে কৃষির বাণিজ্যিকীকরণে শুধুমাত্র আর্থিকভাবে শক্তিশালী কৃষিজীবীরাই কৃষির উন্নতি সুযোগ-সুবিধা কিছুটা কাজে লাগাতে পেরেছিল। বাস্তবে ভারতের সাধারণ কৃষকরা কৃষির বাণিজ্যিকীকরণে লাভের মুখ কোনোদিনও দেখতে পায়নি। সাধারণ কৃষকদের কৃষির উন্নতির প্রয়োজনে ভালো গবাদি পশু, উন্নত বীজ, সার ও যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা সম্ভব ছিল না। তা ছাড়া কৃষিজাত ফসলের সর্বোচ্চ লাভটুকু কৃষকরা ছেড়ে দিতে বাধ্য হত ঔপনিবেশিক সরকার, জমিদার ও মহাজনদের হাতে। মধ্যপ্রদেশের অসংখ্য কৃষক অতিরিক্ত ঋণের চাপে প্রায়ই দাসে পরিণত হয়েছিলেন। বাংলার অনেক চাষি জমি হারিয়ে ভাগচাষি বা বর্গাদার রূপে চিহ্নিত হয়েছিল।


১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ভারতে রেলপথ বসানোর জন্য প্রায় ৩৬০ কোটি টাকা খরচ করা হয়েছিল। অথচ কৃষিতে জলসেচের অনেক উপকারিতা বুঝেও ওই পর্যায়ে কৃষিতে মাত্র ৫০ কোটি টাকারও কম অর্থ বিনিয়োগ করা হয়েছিল। ঊনবিংশ শতকের দ্বিতীয় - ভাগে আমেরিকার গৃহযুদ্ধের প্রভাবে দাক্ষিণাত্যে কার্পাস তুলোর চাষ বেড়ে গিয়েছিল। কিন্তু আমেরিকার গৃহযুদ্ধ থেমে যাওয়ার পর দাক্ষিণাত্যে ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ তুলোর দাম একদম কমে যায়। এর ওপর আবার চড়া রাজস্ব, খরা, অজম্মা, স্থানীয় সাহুকার মহাজনদের চালাকিতে কৃষকরা চূড়ান্ত দুর্দশার শিকার হয়েছিল। বাধ্য হয়ে একসময় বিদ্রোহী চাষিরা বাস্তকার মহাজনদের দখলে থাকা কাগজপত্র পুড়িয়ে দেয়। আহমদনগর ও পুনা জেলার এই ভ্যাকের বিদ্রোহকে ঔপনিবেশিক শাসকরা 'দাক্ষিণাত্য হাঙ্গামা' নামে চিহ্নিত করেছিল। ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দের মে থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত এই বিদ্রোহ চলেছিল।


অসমের চা বাগান ও শ্রমিক অধিকার ও সামান্য মজুরি ও চূড়ান্ত দুর্দশার শিকার অসমের চা বাগিচা শিল্পের শ্রমিকদের অধিকারের পক্ষে সওয়াল করেছিলেন ব্রাহ্মনেতা দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়। দ্বারকানাথের সঙ্গী রামকুমার বিদ্যারত্বও সম্ভাবনী পত্রিকাতে অসমের চা-বাগানের শ্রমিকদের ওপর ইউরোপীয় মালিকদের অকথা কথা বুলি কাহিনী নিবন্ধে ধারাবাহিক ভাবে লিখেছিলেন। ঔপনিবেশিক ভারতে শ্রমিকদের হয়ে এই লড়াই দেশের সমস্ত মানুষের ও ঔপনিবেশিক শাসকদের মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল। এটি একটি অন্যতম পুরোনো নজির।


ঔপনিবেশিক প্রশাসনের তরফে কৃষকদের জন্য আইন ও দাক্ষিণাত্যে কৃষক নিদ্রোহগুলির কারণে ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে ঔপনিবেশিক প্রশাসন কৃষকদের সুবিধার্থে | Agriculture's Relief Act জারি করে। এই আইনের মাধ্যমে ঋণগ্রস্ত কৃষকাদের গ্রেফতার, সাংকার-মহাজনদের আক্রমণ ইত্যাদি অনেকখানি কমে যায়। একইভাবে ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দের প্রজাস্বত্ব আইন বা Tenancy Act-এর মাধ্যমে বাংলায়ও জমিদারের অত্যাচার থেকে কৃষকদের অনেকখানি মুক্তি দেওয়া হয়। তবে দাক্ষিণাত্যে ও বাংলায় বিপুল সংখ্যক কৃষিশ্রমিক ও ভাগচাষিদের স্বার্থের দিকে ঔপনিবেশিক প্রশাসন বিশেষ নজর দেয়নি। আদালতের পরোয়ানা ছাড়া জমি থেকে উচ্ছেদ করা যাবে না।


• শিল্প-বাণিজ্য শুল্কনীতি: 

ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এদেশে এসেছিল বাণিজ্য করতে। কিন্তু ব্রিটেনের রত্ন উৎপাদকদের চাপে ব্রিটেনের সরকার ১৭২০ খ্রিস্টাব্দে ভারত থেকে ব্রিটেনে সুতির বস্ত্রের আমদানি বন্ধ করে দেয়। পাশাপাশি, অন্যান্য কাপড় আমদানির ওপরেও চড়ানো হয় চড়া শুল্ক। ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে পলাশির যুদ্ধের পর ভারতের ব্যাবসাবাণিজ্যকে নিয়ন্ত্রণ করার জায়গায় চলে যেতে থাকে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। এরপর ব্রিটিশ কোম্পানি রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার করে দেশীয় বাণিজ্যে শুল্কনীতি নির্ধারণ করায় বাংলার তাঁতশিল্প ভয়ংকর ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কাঁচা সুতো বিক্রির ব্যবসায় কোম্পানির একাধিপত্য থাকায় বাংলার তাঁতি দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হতে থাকে। ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে চড়া দামে আমদানিজাত কাঁচামাল ক্রয় করে উৎপাদিত বস্ত্র সস্তা দামে বিক্রি করতে বাধ্য হওয়ায় ভারতীয় বস্ত্রশিল্প ও হস্তশিল্প অচল হয়ে পড়ে। ভারতের বাজারে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়া আধিপত্য ক্রমশ প্রতিষ্ঠিত হয়।


অবশিল্পায়ন :

 ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত থেকে ভারতের বাজারের একচেটিয়া অধিকার চলে যায় ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে। বিপুল পরিমাণে ব্রিটিশ পণ্য ভারতে আমদানি হওয়ায় দেশীয় শিল্পগুলি ক্রমেই ধ্বংস হতে থাকে। একে বলে অবশিল্পায়ন। ওইসব শিল্পে নিযুক্ত মানুষেরা জীবিকাহীন হয়ে পড়েন। বিপুল সংখ্যক কর্মচাত শ্রমিক কৃষিকাজে যুক্ত হয়ে পড়লে কৃষিনীতিতে চাপ পড়ে। ঊনবিংশ শতাকের দ্বিতীয়ার্ধে। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হওয়ায় বিদেশি পণ্যে ভারতীয় বাজার জমজমাট হয়ে যায়। ফলে অবনমন হয়ে পড়ার ফলে এদেশের ভাত, কাঠ, চামড়া ইত্যাদি শিষে জড়িত বেকার মানুষেরা রেলপথ ও রাস্তা বানানোর কাজে শ্রমিকে পরিণত হয়।


ব্রিটিশ অবাধ বাণিজ্যনীতির প্রভাব ঔপনিবেশিক ভারতীয় অর্থনীতির ওপর ছিল নেতিবাচক। ব্রিটেনে জনপ্রিয় ভারতীয় পণ্যগুলির ওপর চড়া হারে শুল্ক বসানোর জন্য এদেশ থেকে ওইসব পণ্য রপ্তানি বন্ধ হয়ে যায়। ভারতের চা, নীল ইত্যাদি কাঁচামাল হিসেবে ব্রিটেনে রপ্তানি হতে থাকে। ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের পর থেকেই ব্রিটেনের শিল্প-চাহিদার দিকে লক্ষ রেখেই ভারতে ঔপনিবেশিক শাসনের শিল্পনীতি নির্ধারিত হতে থাকে। যোগাযোগ ব্যবস্থায় রেলপথের সৃষ্টি হওয়ায় গ্রামগুলি পরস্পরের সংলগ্ন হয়ে পড়ে। ফলে প্রত্যন্ত গ্রামেও ব্রিটিশপণ্যের বিপুল আমদানি হওয়ায় গ্রামীণ পণ্য সব লুকিয়ে পড়তে বাধ্য হয়। এভাবে হস্তশিল্পগুলি ধ্বংস হওয়ায় ফলে অনেক শহরও ক্রমে আগের জৌলুশ হারায়। মুরশিদাবাদ, ঢাকা, সুরাট ইত্যাদি শহরগুলির জনগণ বাধ্য হয়ে গ্রামের কৃষি ব্যবস্থায় আশ্রয় নেয়। ফলে ভারতে কৃষি ও শিল্প অর্থনীতির সামাসা বিঘ্নিত হয়।।




ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের 'রত্ন' : আঠারো শতকের শেষ দিক থেকে পরবর্তী প্রায় দেড়শো বছর ঔপনিবেশিক প্রশাসন ভারতের অর্থনীতিতে সাম্রাজ্যের প্রয়োজনে ঘোরভাবে পরিচালিত করতে সচেষ্ট হন। ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ ব্রিটেনের ল্যাংকাশায়ারে তৈরি সুতির কাপড়ের ৮৫ শতাংশ বিক্রি হত ভারতে। ভারতীয় রেলের জন্য লোহা ও ইস্পাতের ১৭ শতাংশ আসত ব্রিটেন থেকেই। তাই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মধ্যে ভারতকেই বলা হত সবচেয়ে দামি


ঊনবিংশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে ভারতে বেশ কিছু যন্ত্রনির্ভর শিল্প গড়ে উঠতে থাকে। ১৮৫০ থেকে ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বোম্বাই এবং হুগলির রিষড়ায় সুতির কাপড়, পাট, কয়লা ইত্যাদি শিল্পে কর্মী হিসেবে অনেকেই নিযুক্তি লাভ করে। বিংশ শতকের গোড়ায় চামড়া, চিনি, লৌহ-ইস্পাত ও বিভিন্ন খনিজ শিল্প গড়ে ওঠে। এসব শিল্পে বেশির ভাগ বিনিয়োগ হত ব্রিটিশ মূলধন। ওদের শিল্পে ব্রিটিশ বিনিয়োগকারীদেরকে ঔপনিবেশিক সরকার যেভাবে সহযোগিতা করেছিল সেই সহযোগিতা দেশীয় শিল্পোদ্যোগীরা লাভ করতে পারেননি। ধীরে ধীরে অবশ্য ভারতীয় ব্যবসায়ীরা দেশীয় ব্যাংকে ও বিমা কোম্পানি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগী হয়।


ঔপনিবেশিক সরকার দেশীয় পণ্য পরিবহণের জন্য রেল মাশুলের চড়া হার নির্ধারণ করেছিল। ফলে দেশীয় শিল্পের অগ্রগতি আটকে রেখেছিল মূলত সুতি ও পাটশিল্পে। এমনকি ব্রিটিশ উৎপাদকরা ক্রমাগত ঔপনিবেশিক সরকারকে দেশীয় শিল্প বিরোধী অবস্থান গ্রহণের জন্য চাপ দিয়ে চলেছিল। ফলে ঔপনিবেশিক শাসনাধীন ভারত সার্বিক শিল্পায়নের সযোগ লাভ করেনি।


• রেলপথ ও ভারতে রেলপথ বানানোর পদ্ধতি থেকে স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে, ঔপনিবেশিক শাসনকে গতিশীল করাই ছিল এর মূল উদ্দেশ্য। গভর্নর জেনারেল লর্ড ডালহৌসি এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে দ্রুত সেনাবাহিনি পাঠানোকে সুনিশ্চিত করার জনাই ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে ভারতে রেলপথ নির্মাণের প্রকল্প গ্রহণ করেন। এ ছাড়া ব্রিটিশ পণাকে ভারতের প্রতিটি বাজারে, বন্দরে ও শহরেও দ্রুত পৌঁছে দেওয়ার কাজে রেলপথ ছিল প্রধান সহায়। রেলপথ নির্মাণের ব্যয়বহুল প্রকল্পে ব্রিটিশ মূলধন বিনিয়োগের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ফলে ১৮৫৮-১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ৭ কোটি পাউন্ডেরও বেশি অর্থ ব্রিটেনের বিভিন্ন কোম্পানি ভারতীয় রেলপথ নির্মাণে বিনিয়োগের সুযোগ পেয়েছিল।


উপনিবেশে রেলপথ নির্মাণের প্রধান উদ্দেশ্যই ছিল ব্রিটিশ সরকারের স্বার্থরক্ষা। ভারতে রেলপথ নির্মাণের প্রকল্পের জন্য ব্রিটেন থেকে রেলপথ বানানোর সর্যাম, লোহা, কয়লা আমদানি করা হত। রেলপথ নির্মাণকে কেন্দ্র করে উন্নত প্রযুক্তি শিক্ষা থেকে ভারতীয়দেরকে সচেতনভাবেই সরিয়ে রাখা হয়েছিল। তা ছাড়া রেলপথ বানানোর জন্য জলনিকাশি ব্যবস্থার ক্ষতি হয়েছিল, অনেক জঙ্গল কাটা পড়েছিল, পরিবেশ দূষিত, হয়েছিল, অনেক অরণ্যবাসী জনগোষ্ঠীর জমি, জীবিকা ও মর্যাদার হানি ঘটানো হয়েছিল।



একটি হিসাব অনুযায়ী জানা যায় যে, প্রতি মাইল রেললাইন বসাতে নাকি ২০০০টি

স্লিপার লাগত। যদি পাঁচটি স্লিপার বসাতে গড়ে একটি প্রমাণ মাপের গাছ কাটা

হয়, তাহলে প্রতি মাইল স্লিপার পিছু কতগুলি গাছ কাটা হয়েছিল? এর ফলে পরিবেশের ওপর রেলপথের কী প্রভাব পড়েছিল বলে মনে হয় ?। উত্তর : উপরিউক্ত হিসাব অনুসারে প্রতি মাইয়া স্লিপার পিছু প্রমাণ মাপের গাছ কাটা হয়েছিল ২০০০ + ৫ = ৪০০টি। সুতরাং এই হিসাবে ভারতে যে সুদীর্ঘ রেলপথ বানানো হয়েছিল তাতে যে কয়েক লক্ষ প্রমাণ মাপের গাছ কাটা হয়েছিল তা স্পষ্টই বোঝা যায়। ওই রকম নির্বিচারে গাছ কেটে ফেলার জন্য ভারতের পরিবেশ যে কতখানি দুষিত হয়েছিল তা খুব সহজেই অনুমান করা যায়।



রেলভ্রমণের অভিজ্ঞতা : ভারতে রেল চলাচল শুরু হওয়ায় পর রেল চড়াকে কেন্দ্র করে সাধারণ মানুষের নানারকম অভিজ্ঞতা হয়েছিল। একটি অভিজ্ঞতার কথা মহানন্দ চক্রবর্তীর 'রেলপথ ভ্রমণ বর্ণনা' নামক লেখা থেকে জানা যায়। অনেক দিন আয়োজনের পর মফসল থেকে তিনি কলকাতার উদ্দেশ্যে যাওয়ার জন্য রাত দশটায় বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন। শক্তিপীঠ স্টেশনে জয়ঘণ্টা শুনে একে একে ট্রেনে উঠে বসলেন। ঘন্টা বাজিয়ে ট্রেন ছাড়ল। মহাশব্দ করে নদনদী পার হয়ে এগোতে লাগল। বিরামহীন গতিতে বেগবতী নদী যেমন ছুটে চলে সেইভাবে ট্রেন বৈদ্যবাটি, ফ শ্রীরামপুর ইত্যাদি পার হয়ে দশ ঘণ্টা পরে হাওড়ায় গিয়ে পৌঁছোলেন।


ভারতীয় সমাজের অনেকের মতে, রেলপথ নির্মাণের পরিবর্তে যদি ঔপনিবেশিক প্রশাসন সেচ ব্যবস্থার উন্নতিতে নজর দিত তাহলে ভারতের কৃষি ব্যবস্থায় অনেক উপকার হত। অনেকের আবার অভিমত হল, ভারতের রাজস্ব থেকে রেলপথ নির্মাতা কোম্পানিগুলিকে সুদ দেওয়ার ফলে দেশের সম্পদ বাইরে চলে গিয়েছিল। তবে একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, রেলপথ নির্মাণের ফলে ভারতের বাজারগুলি অনেক পরিমাণেই একজোট হয়েছিল। পণ্য ও যাত্রী পরিবহণও হয়েছিল সহজতর। 

ঔপনিবেশিক ভারতে টেলিগ্রাফ ব্যবস্থার বিকাশ : ঊনবিংশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে বোলপথ বরাবর টেলিগ্রাফ লাইন তৈরি করা হয়। এমনকি টেলিগ্রাফে রেলস্টেশনগুলির মধ্যে যোগাযোগ করা প্রয়োজন হত। তার মধ্য দিয়ে রেলের সিগন্যাল ব্যবস্থা কার্যকর করা যেত। ১৮৫১ থেকে ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ভারতে প্রায় ৪ হাজার ২৫০ মাইলেরও বেশি অঞ্চল টেলিগ্রাফ যোগাযোগের আওতায় এসে গিয়েছিল। ভারতীয় উপমহাদেশে ৪৬টি টেলিগ্রাফ কেন্দ্রের মাধ্যমে কলকাতা থেকে আগ্রা এবং উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলসমূহ এবং বোম্বাই, মাদ্রাজ, ও ওটাকামুন্দ প্রভৃতি অসলে টেলিগ্রাফ যোগাযোগ বিস্তৃত হয়েছিল। এরপর ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ১৭ হাজার ৫০০ মাইল এবং ঊনবিংশ শতকের শেষ দিকে ৫২ হাজার ৯০০ মাইল জুড়ে টেলিগ্রাফ লাইন ছড়িয়ে পড়েছিল।


ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের রাজনৈতিক স্বার্থে টেলিগ্রাফ ব্যবস্থা যথেষ্ট সহায়ক হয়েছিল। ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় ইচ্ছা-বার্মা যুদ্ধের সময় বার্মার রাজধানী রেঙ্গুনের পরাজয়ের খবর লর্ড ডালহৌসি কলকাতায় বসে পেয়েছিলেন টেলিগ্রাফের মাধ্যমেই। বৈদ্যুতিক টেলিগ্রাফের জন্যই ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের সিপাহি বিদ্রোহ ইত্যাদি থেকে ব্রিটিশ প্রশাসন রক্ষা পেয়েছিল। ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে টেলিগ্রাফের কল্যাণে ভারত ও ব্রিটেনের যোগাযোগ খুব সহজ হয়ে যায়। ভারতবর্ষের ওপর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের আধিপত্য সুদূর প্রসারিত হয়েছিল টেলিগ্রাফ যোগাযোগের মাধ্যমেই।


সম্প্রতি কলকাতায় টেলিগ্রাফ অফিস বন্ধ হয়ে গেল। তোমার স্থানীয় অঞ্চলের পরিবহণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ইতিহাস নিয়ে একটি চার্ট বানাও।


 সম্পদের বহির্গমন :

 সম্পদ নির্গমন, অবশিল্পায়ন আর দেশীয় জনগণের দারিদ্রাই ঔপনিবেশিক শাসনের সৃষ্ট তিনটি প্রধান কুফল। ব্রিটেনের স্বার্থেই ভারতের সম্পদকে ব্যবহার করা হয়েছিল। বিনিময়ে ভারতের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ক্রমাগত ধ্বংসের যুগে এগিয়ে চলেছিল। দেশের সম্পদ বিদেশে চালান হওয়াকেই 'সম্পদের বহির্গমন' বলা হত। ১৮৪০ খ্রিস্টাব্দে এক ব্রিটিশ আধিকারিকের বক্তব্য থেকে জানা যায় যে, ভারত থেকে বছরে ২ থেকে ৩ কোটি স্টার্লিং মূল্যের সম্পদ ব্রিটেনে পাঠানো হত। বাস্তবে ভারতে সম্পদ বহির্গমনের ক্ষেত্রে ব্রিটিশ শাসন 'স্পর্শ্বের মতো কাজ করত। অর্থাৎ, ভারত থেকে সম্পদ শুষে নিয়ে ব্রিটেনে পাঠানো হত। ঊনবিংশ শতক শেষ হওয়ার আগে ভারতীয় জাতীয় আয়ের ৬ শতাংশ এবং জাতীয় সমায়ের এক-তৃতীয়াংশ সম্পদ নির্গমন হয়ে যেত। এই কালপর্বে ব্রিটেনের জাতীয় আয়ের ২ শতাংশ ছিল ভারত থেকে নির্গত সম্পদ।


• ভারতের দারিদ্রা ভারতীয় উপমহাদেশে ১৮৫৪ থেকে ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে প্রায় ২ কোটি ৮১ লক্ষ মানুষ দুর্ভিক্ষে প্রাণত্যাগ করে। প্রায় ৪ কোটি ভারতবাসী আধপেটা খেয়ে বেঁচেছিল। এই দূর্ভিক্ষাকে মূলত ঔপনিবেশিক প্রশাসনের চরিত্রকেই দায়ী করা হয়। এর কারণ সম্পদের একনাগাড়ে বহিগর্মন ও অবশিল্পায়ন। ঔপনিবেশিক অর্থনৈতিক নীতির ফলেই সামাজিক ভাবে দারিদ্র স্থায়ী হয়েছিল। ফলে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের গোড়ার দিকে অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদীরা ভারতের দারিদ্র্য নিয়ে সোচ্চার ছিলেন।


ঔপনিবেশিক শাসনে ভারতের উন্নয়ন ঃ 

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের চোখে বঙ্কিমচন্দ্র লিখিত 'রাদেশের কৃষক' প্রবন্ধের প্রথম পরিচ্ছেদ নেওয়া পাঠ্যাংশে বর্ণিত উদ্ধৃতিটির সারাংশ হল- বঙ্কিমচন্দ্র কঠোর ব্যঙ্গোক্তি করে বলেছেন, আজকাল নাকি আমাদের দেশের খুব শ্রীবৃদ্ধি হচ্ছে। তাঁর সময়ে দেশের শ্রীবৃদ্ধি নিয়ে যে বিশাল হইচই শুরু হয়েছিল তা কি যথার্থই শ্রীবৃদ্ধি বা দেশের মঙ্গল ছিল? বঙ্কিমচন্দ্রের মতে, রেল যোগাযোগ বা টেলিগ্রাফের সুফল মাত্র মুষ্টিমেয় কয়েকজন ভারতীয় ভোগ করতে পেরেছিল। কিন্তু যে কোন কোন দরিদ্র কৃষকের দিনান্ত কঠোর পরিশ্রমের ফলে ভারতের এই যে তথাকথিত শ্রীবৃদ্ধি বা মাল নিয়ে হইচই হচ্ছিল | সেই হতভাগ্য কৃষকদের একাংশেরও মশাল কিছু হয়েছিল। তারা দুপুরের রোদে, খালি মাথায়, খালি পায়ে, এক হাঁটু কাদার ওপর দিয়ে অস্থিচর্মসার দুটো বলদ নিয়ে, ভোঁতা লাঙল টেনে চাষ করে। ভাদ্রে তাদের রৌদ্রে মাথা ফাটে, তৃয়ায় বুক ফাটে, এই চাষের সময় বাড়ি ফিরে পেটে অন্ন জোটে না। সন্ধ্যায় নুন, লঙ্কা দিয়ে ভাঙাপাত্রে আধপেটা ভাত খেয়ে ছেঁড়া মাদুরে, না হলে মাটিতেই শুয়ে মশার কামড় খেয়ে রাত কাটাতে হয়। সকালে আবার মাঠে যাওয়ার পথে হয় জমিদার নয়, মহাজনের আক্রমণে পড়ে মাঠে যাওয়া হয় না। অথবা দেনার অজুহাতে জমিদার জমি কেড়ে নেয়। ফলে হতভাগা কৃষকের সপরিবারে উপবাসে কাটাতে হয়। সুতরাং বঙ্কিমচন্দ্রের মতে, যে দেশটা কৃষিজীবীর দেশ বলেই সুপরিচিত সেখানে কৃষকরাই যদি এভাবে চরম দুঃখ ও দারিদ্র্যের শিকার হন তবে আর দেশের প্রকৃত মঙ্গল হল কীভাবে?


About the Author

Hello Friends, welcome to our website Daily GK Career , founded on 27 April 2023 by Sandip Sanki. Daily GK Career is a free professional Education platform where we provide Free online mock test, govt exam, WBCS, RAIL, GROUP D, BANK, POST Office, …

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp Group Join Now
Telegram Group Join Now
Cookie Consent
We serve cookies on this site to analyze traffic, remember your preferences, and optimize your experience.
Oops!
It seems there is something wrong with your internet connection. Please connect to the internet and start browsing again.
AdBlock Detected!
We have detected that you are using adblocking plugin in your browser.
The revenue we earn by the advertisements is used to manage this website, we request you to whitelist our website in your adblocking plugin.
Site is Blocked
Sorry! This site is not available in your country.