WhatsApp Group Join Now
Telegram Group Join Now

অষ্টম শ্রেণীর ইতিহাস |পঞ্চম অধ্যায় | ঔপনিবেশিক শাসনের প্রতিক্রিয়া : সহযোগিতা ও বিদ্রোহ

১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে বাংলা ভাষায় প্রথম মাসিক পত্রিকা দিগদর্শন ও সাপ্তাহিক পত্রিকা সমাচার দর্পণ প্রকাশিত হয়।

 অষ্টম শ্রেণীর ইতিহাস |পঞ্চম অধ্যায় | ঔপনিবেশিক শাসনের প্রতিক্রিয়া : সহযোগিতা ও বিদ্রোহ

 



ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক প্রশাসনে ভারতের সমাজ ও শিক্ষা সংস্কারের উদ্যোগে অনেক ভারতীয়ই অংশগ্রহণ করেছিলেন। ঊনবিংশ শতকের ভারতে সমাজ ও শিক্ষা সংস্কারে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকদের আদর্শে তাদের যথেষ্ট আস্থা ছিল। ব্রিটিশ শাসনের সহগামী হিসেবেই দেশীয় সমাজ ও সংস্কৃতির উন্নয়ন সম্ভব বলে তাঁদের ধারণা ছিল।


ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক প্রশাসন এদেশে শিক্ষাব্যবস্থার নামে কিছু সরকারি কর্মচারী তৈরির চেষ্টায় ছিল। কিন্তু ইংরেজি ভাষা ও পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে শিক্ষিত অনেক ভারতবাসী ঔপনিবেশিক সরকারের এদেশে সমাজ ও ধর্মসংস্কারকে ঘিরে নানা বিতর্কের ঝড় তুলেছিলেন। সাধারণভাবে আর্থিক সচ্ছলতার মাঝামাঝি স্তরে অবস্থানকারী মানুষদের মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক বলা হত। কলকাতা, বোম্বাই ও মাদ্রাজকে কেন্দ্র করে এমনই কিছু শিক্ষিত ভদ্রলোক ভারতের সামাজিক সংস্কারে প্রাণপণ উদ্যোগী হয়ে উঠেছিলেন।


• বাংলায় সমাজসংস্কার আন্দোলন :

 সতীদাহপ্রথা রদ ও বিধবাবিবাহ প্রচলন : ঊনবিংশ শতকের গোড়ার দিকে কোম্পানি শাসকরা আইন প্রণয়ন করে এদেশের বেশ কিছু নৃশংস ও অমানবিক রীতিনীতি বন্ধ করতে সচেষ্ট হয়। ওই সময়ে অনেক শিক্ষিত ভারতবাসীও এদেশের সমাজসংস্কারে উদ্যোগী হয়ে ওঠেন। বাংলায় সমাজসংস্কারে প্রধান উদ্যোগী ছিলেন রাজা রামমোহন রায়। তিনি হিন্দুধর্মের সংস্কার করতে উদ্যোগী হয়ে মূর্তিপূজা, পুরোহিততন্ত্র এবং অসংখ্য ঈশ্বরপূজার নিন্দা করেন। দেশে চিরাচরিত সতীদাহপ্রথার তীব্র প্রতিবাদ চেয়ে জনমত গড়ে তুললে ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে লর্ড বেন্টিংক আইন করে সতীদাহপ্রথা বন্ধ করেন। রামমোহন সম্পত্তিতে নারীর আইনগত স্বীকৃতির ক্ষেত্রেও সওয়াল করেন।


সংবাদপত্র ও জনমত গঠন :

 ভারতীয় জনমত গঠনে এবং শিক্ষা ও সমাজসংস্কারে সংবাদপত্রসমূহের অবদান অনস্বীকার্য। ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত জেমস অগাস্টাস হিকির বেঙ্গাল গেজেট নামে নির্ভীক নিরপেক্ষ সাপ্তাহিক সংবাদপত্রটি কোম্পানি প্রশাসনের কোপে পড়ে বন্ধ হয়ে যায়। শ্রীরামপুরের মিশনারি মার্শম্যানের সম্পাদনায়

১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে বাংলা ভাষায় প্রথম মাসিক পত্রিকা দিগদর্শন ও সাপ্তাহিক পত্রিকা সমাচার দর্পণ প্রকাশিত হয়। অনেক শিক্ষিত ভারতীয় তখন সমাজসংস্কারের চেষ্টায় বিভিন্ন সংবাদপত্র প্রকাশ ও সম্পাদনায় প্রবৃত্ত হন।


সতীদাহ রদ বিষয়ে রামমোহনের সওয়াল : 'প্রবর্তক' শিরোনামে রামমোহন লিখেছেন যে, স্ত্রীলোক স্বভাবত অন্নবৃদ্ধি, অস্থিরচিত্ত, বিশ্বাসের অপাত্র ও ধর্মজ্ঞান শূন্যা হয়। স্বামীর মৃত্যুর পরে সে পতিতা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই তাকে বাল্যকাল থেকেই সর্বদা উপদেশ দেওয়া হয় যে, স্বামীর সঙ্গে চিতায় শুয়ে স্বর্গে যাওয়া মহা পুণ্যের কাজ। কিন্তু আগুনের ভয়ে কোনো বিধবা চিতা থেকে পালাতে পারে এই আশঙ্কায় মৃত স্বামীর সঙ্গে। তাকে চিতায় বেঁধেই দাহ করা হয়। তাঁর 'নিবর্ত্তক' প্রবন্ধে রামমোহন বলেছেন যে, স্ত্রীলোকদিগের বুগির পরীক্ষা না করেই তাদের বিদ্যালাভে বল্গুনা করা হয়। এদেশের কর্তাব্যক্তিরা স্ত্রীলোকেদেরকে শিক্ষা বা জ্ঞানোপদেশ না দিয়েই তাদের শুধু শুধু বুদ্ধিহীন বলে প্রচার করে চলেছেন।


রামমোহনের মতো বিদ্যাসাগরও ঊনিশ শতকের মাঝামাঝি বিধবা রমণীদের পুনরায় বিবাহ দেওয়ার দাবি জানিয়ে ব্রিটিশ প্রশাসনের কাছে প্রার্থনা করেন। ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে হিন্দু বিধবা পুনর্বিবাহ আইন জারি হয়। কিন্তু সমাজের সর্বস্তরে বিধবাবিবাহ প্রথা গৃহীত হয়নি। শুধুমাত্র বিদ্যাসাগরের নিজস্ব উদ্যোগে কয়েকজন বিধবার বিবাহ হয়।


 বিধবাবিবাহ প্রবর্তন বিষয়ে বিদ্যাসাগরের যুক্তি :

 ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের 'বিধবাবিবাহ' রচনার বক্তব্যের সারকথা হল, বিদ্যাসাগরের মতে, বিপ্লব বিবাহের প্রথা প্রচলিত না থাকার যে নানাবিধ অনিষ্ট সমাজে ঘটছে তা বুঝে অনেকেই এখন নিজের বিধবা বোনের আধার নিয়ে দিচ্ছে। অনেকে এই বিবাহকে অতি আবশ্যক মনে করলেও সমাজের ভয়ে পিছিয়ে আছেন। কিন্তু বিদ্যাসাগর মনে করেন, বিধবাবিবাহ কোনোক্রমেই শাস্ত্রবিরুদ্ধ নয়। কলিযুগে বিধবাবিবাহ সর্ব প্রকারেই উচিত ধর্ম।


• বাংলায় শিক্ষা সংস্কার : 

ডিরোজিও ও নবাবলা গোষ্ঠী, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও নারীশিক্ষা ঃ কলকাতার হিন্দু কলেজের তরুণ অধ্যাপক ছিলেন হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও। তাঁর গাছ স্বাধীন চিন্তাভাবনায় অনুপ্রাণিত হয়ে তারই একদল ছাত্র 'ইয়ং বেঙ্গল গোষ্ঠী' নামে পরিচিত হয়ে বিভিন্ন সামাজিক প্রথা ও রীতিনীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। অবশ্য একসময় তাঁরা জাতপাত, বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ প্রথার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানালেও পরে তাঁরা নীরব হয়ে যান।


উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজে পড়ানোর সময় থেকেই শিক্ষাসংক্রান্ত নানান সংস্কার করেন। ১৮৫০-এর দশকে ছাত্রদের পড়ার জন্য তিনি অনেকগুলি বই রচনা করেন। তিনি মনে করতেন, শিক্ষা বিষয়ে ঔপনিবেশিক সরকারের নির্দিষ্ট পরিকল্পনা করা উচিত। দেশে নারীশিক্ষা বিস্তারের চেষ্টায় তিনি কলকাতায় বেথুন স্কুল প্রতিষ্ঠায় সহযোগিতা করেন। নিজস্ব ব্যয়ে বাংলার বিভিন্ন জেলায় অনেকগুলি মেয়েদের স্কুলও গড়ে তোলেন।

• ভারতের অন্যত্র সমাজ ও শিক্ষা সংস্কার :

 ১৮৪০-এর দশক থেকে মহারাষ্ট্র তথা পশ্চিম ভারতে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত মানুষরা বিধবাদের পুনর্বিবাহের উদ্যোগ নেন। ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে বিষুশাস্ত্রী পণ্ডিতের নেতৃত্বে বিধবাবিবাহের পক্ষে একটি সভা গড়ে ওঠে। এরপর আত্মারাম পান্ডুরং ও মহাদেবগোবিন্দ রানাডের নেতৃত্বে বোম্বাইয়ে প্রার্থনা সমাজ সামাজিক সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করে।


* নারীশিক্ষা ও পণ্ডিতা রমাবাই :

 উনিশ শতকে নারীশিক্ষাকে কেন্দ্র করে পশ্চিম

ভারতে পণ্ডিতা রমাবাই, মাদ্রাজে ভগিনী শুভলক্ষ্মী ও বাংলায় বেগম রোকেয়া

সাখাওয়াত হোসেন যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন তাতে নারীশিক্ষার খানিকটা বিকাশ ঘটে।

প্রাচীন ভারতীয় শাস্ত্রে জ্ঞানী রমাবাই ব্রাহ্মণকন্যা হয়েও সামাজিক বাধা অগ্রাহ্য করে

শূদ্রকে বিবাহ করেন। বিধবা অবস্থায় তিনি নিজের মেয়েকে নিয়ে ইংল্যান্ডে গিয়ে

ডাক্তারি পড়েন। রক্ষণশীলদের নানা সমালোচনা সত্ত্বেও তিনি বিধবা মহিলাদের জন্য

আশ্রম তৈরি করেছিলেন।


মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির বীরেশলিাম পাণ্ডুলু বাংলার ব্রায় আন্দোলনে প্রভাবিত হয়ে বিধবাবিবাহের পক্ষে সওয়াল করেন ও নারীশিক্ষায় উদ্যোগী হন। সমাজের অনেক শিক্ষিত নাগরিকের সমর্থন নিয়ে তিনি কয়েকজন বিধবা রমণীর পুনর্বিবাহ দিয়েছিলেন।


ধর্মসংস্কার :

 ব্রাহ্ম আন্দোলন ও হিন্দু পুনরুজ্জীবন : রাজা রামমোহন রায় ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে সামাজিক সংস্কারের চেষ্টায় কলকাতায় গড়ে তোলেন আত্মীয় সভা। ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দে আত্মীয় সভা থেকে গড়ে ওঠা ব্রায় সমাজের আন্দোলনকে সংগঠিত করেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। ১৮৫০-এর দশকে কেশবচন্দ্র সেন ও বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী ব্রায় আন্দোলনকে বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে দেন। তবে ব্রায় আন্দোলন সমাজের নিম্নবর্গের মানুষ। পর্যন্ত পৌঁছোনো সম্ভব হয়নি।


* জ্যোতিরাও ফুলে ঃ 

মহারাষ্ট্রের নিম্নবর্গীয় মানুষদের সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় লড়াই করেছিলেন জ্যোতিরাও ফুলে ও তাঁর স্ত্রী সাবিত্রী বাই। ১৮৫১ খ্রিস্টাব্দে পুনা শহরে তিনি নারীশিক্ষা প্রসারের লক্ষ্যে একটি স্কুলে খোলেন। মহারাষ্ট্রে বিধবাবিবাহ প্রচলন করেন। জ্যোতিরাও ফুলের 'সত্যশোধক সমাজ' নীচুতলার মানুষদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় লড়াই করত।


* স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী ও আর্য সমাজ :

 স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে আর্য সমাজ প্রতিষ্ঠা করে বেদোক্ত বিজ্ঞানসম্মত বিচারে হিন্দুধর্মের আচার-সংস্কারের সমালোচনা করেন। মূর্তিপূজা, পুরোহিত প্রাধানা, বাল্যবিবাহ ইত্যাদির তিনি কড়া নিন্দা করেন। তিনি বিধবাবিবাহ ও নারীশিক্ষার প্রতি যথেষ্ট সমর্থন জ্ঞাপন করেন। পদ্মাব ও উত্তর-পশ্চিম ভারতে আর্য সমাজ জনপ্রিয় হয়ে উঠলেও দয়ানন্দের মৃত্যুর পর আম সমাজের আন্দোলনে উগ্ররূপ দেখা যায়।

বাংলায় রাজনারায়ণ বসুর 'জাতীয় গৌরব সম্পাদনী সভা' এবং নবগোপাল মিত্রের 'জাতীয় মেলা' সমাজসংস্কার আন্দোলনে বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করে। হিন্দুধর্মের পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং স্বাধীনতা ও দেশপ্রেমের আদর্শে সকলকে উজ্জীবিত করাই ছিল এঁদের লক্ষ্য। হিন্দু পুনরুজ্জীবনবাদী আন্দোলনে রামকৃরু পরমহংসের ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে তাঁরই শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দ আমেরিকার শিকাগো ধর্ম সম্মেলনে যোগ দিয়ে ভারতীয় দর্শন ও হিন্দু ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের চেষ্টা করেন।


• সংস্কার আন্দোলনগুলির চরিত্র ও সীমাবদ্ধতা ও উনিশ শতকের বাংলায় শুধুমাত্র উচ্চবর্গের শিক্ষিত মানুষদের সংকীর্ণ সীমানায় আবদ্ধ এই আন্দোলনগুলির প্রভাব বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে পড়লেও সমাজের সাধারণ মানুষের মনকে স্পর্শ করতে পারেনি। পশ্চিম ও দক্ষিণ ভারতেও এই সংস্কার আন্দোলনগুলি জাতিভেদ নিয়ে বিশেষ সোচ্চার হয়নি বলে শুধুমাত্র শিক্ষিত ভদ্রশ্রেণির মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকেছিল। উনিশ শতকের সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষের ধর্মীয় অপব্যাখ্যা দূর করে হিন্দু সমাজের কুপ্রথা বন্ধ করতে সচেষ্ট ছিলেন। রামমোহনের সতীদাহপ্রথা রদ কিংবা বিদ্যাসাগরের বিধবাবিবাহ প্রচলন কুসংস্কারাচ্ছন্ন হিন্দুসমাজকে অনেকখানি উজ্জীবিত করে তোলে।


• মুসলিম সমাজে সংস্কার প্রক্রিয়া :

 আলিগড় আন্দোলন : 

উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে মুসলমান সমাজেও বিভিন্ন সংস্কার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। কলকাতায় এই উদ্দেশ্যে ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে মহামেডান লিটেরারি সোসাইটি প্রতিষ্ঠিত হয়। স্যার সৈয়দ আহমদ খান মুসলমান সমাজে ইংরেজি শিক্ষার বিস্তার ও বিজ্ঞান শিক্ষা চর্চার প্রসার ঘটিয়ে পুরোনো প্রথা ও যুক্তিহীন অন্ধবিশ্বাসের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। তিনি আধুনিক যুক্তিবাদ বিজ্ঞানের আলোয় কোরানকে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছিলেন। ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে স্যার সৈয়দ আহমদ প্রতিষ্ঠিত আলিগড় অ্যাংলো ওরিয়েন্টাল কলেজে হিন্দু-মুসলমান উভয় শ্রেণিরই ছাত্র-শিক্ষক ছিলেন। তবে স্যার সৈয়দ আহমদের সংস্কার প্রক্রিয়াগুলি মূলত উচ্চ ও মধ্যবিত্ত মুসলমানদের মধ্যে চর্চিত হচ্ছিল—এগুলি মুসলমান সমাজের গরিব নিরক্ষর মানুষদের গৃহকোণ পর্যন্ত পৌঁছোতে পারেনি।



• কৃষক ও উপজাতি সমাজের বিদ্রোহ :

 আঠারো শতকের শেষ ও উনিশ শতকের শুরু—এই সময়পর্বে ব্রিটিশ কোম্পানি প্রশাসন যে ভূমি রাজস্ব সংক্রান্ত নানা রদবদল ঘটিয়েছিল তার মন্দ প্রভাব পড়েছিল কৃষক ও উপজাতি সমাজের ওপর। ফলে ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন অংশে কৃষক ও উপজাতি মানুষজন রীতিমতো বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিল। তাদের আক্রমণের লক্ষ্য ছিল ব্রিটিশ প্রশাসন এবং স্থানীয় জমিদার, ইজারাদার ও মহাজনদের বিরুদ্ধে।


সাঁওতাল । হুল (১৮৫৫-৫৬ খ্রিস্টাব্দ) : 

সাঁওতালদের ভাষায় জমিদাররা বা বহিরাগতরা দিকু নামে পরিচিত। সাঁওতালরা দীর্ঘদিন বহিরাগত ওই মহাজন জমিদার তথা দিকদের খপ্পরে পড়ে দুর্বিষহ জীবন ও শোষণের মুখে পড়ে। এ ছাড়া ঔপনিবেশিক প্রয়োজনে জঙ্গল কেটে রেলপথ তৈরি করলে কৃষক ও উপজাতিদের ভয়ংকর ক্ষতি সাধিত হয়। সাঁওতালদের নিজস্ব সংস্কৃতিতে আঘাত হানে। ইউরোপীয় কর্মচারীরা স্বল্প মজুরিতে তাদের রেলপথ তৈরির কাজে যোগ দিতে বাধ্য করে। এসবের বিরুদ্ধে সিধু, কানহু, চাঁদ ও ভৈরব প্রমুখ সাঁওতাল নেতারা সাঁওতালদের সংগঠিত বিদ্রোহ (হুল) ঘোষণা করে। তারা মহাজন, জমিদার ও ব্যবসায়ীদের বাড়ি কুঠি আক্রমণ করে। ভাগলপুর থেকে রাজমহল পর্যন্ত দ্রুত ছড়িয়ে পড়া এই বিদ্রোহ দমন করতে ঔপনিবেশিক প্রশাসন সিধু ও কানহুসহ হাজার হাজার সাঁওতালদের হত্যা করে। তথাপি সাঁওতালদের এই বিদ্রোহ শান্ত করতে ব্রিটিশ প্রশাসন সাঁওতাল পরগনা নামক পৃথক একটি এলাকা গড়ে তুলে দিতে বাধ্য হয়।


 সাঁওতাল বিদ্রোহ ও হিন্দু প্যাট্রিয়ট : 

সাঁওতালদের বিদ্রোহে কলকাতায় শিক্ষিত হিন্দু বাঙালিরা অনেকেই ব্রিটিশ প্রশাসনের এমন নিষ্ঠুর দমনপীড়নের ধিকার দেওয়া দূরের কথা, উলটে সাঁওতালদেরই নিন্দা করেন। কিন্তু 'হিন্দু প্যাট্রিয়ট' সংবাদপত্রের সম্পাদক হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, শান্ত ও সৎ সাঁওতালদের জোর করে বেগার খাটানো হয়েছে, অতিরিক্ত খাজনা দিতে না পারলে অত্যাচার করা হয়েছে। সুতরাং নিজেদের জঙ্গল ও উপত্যকার মধ্যে স্বাধীনভাবে জীবনযাপনের অধিকার চাইতে গিয়ে বিদ্রোহী সাঁওতালদের যেভাবে নির্মম হাতে হত্যা করা হয়েছে তাতে হত্যাকারীদেরই শাস্তি হওয়া উচিত।


* মালাবারের মোপালা বিদ্রোহ :

 দক্ষিণ ভারতের মালাবার অঞ্চলের মোপালারা অধিকাংশই কৃষি শ্রমিক, ছোটো ব্যবসায়ী এবং জেলে। ব্রিটিশরা মালাবার দখল করে গরিব কৃষকদের ওপর রাজস্বের বোঝা ও বিভিন্ন কর চাপিয়ে দেয়, জমিতে কৃষকদের অধিকার থেকে বর্ণিত করে। ফলে মালাবার অঞ্চলে একের পর এক বিদ্রোহ দেখা দেয়। ব্রিটিশ প্রশাসন সশস্ত্র বাহিনীর মাধ্যমে বিদ্রোহ দমনে সচেষ্ট হয়।


• ওয়াহাবি আন্দোলন ও বারাসাত বিদ্রোহ ঃঃ

 আবদুল ওয়াহাব-এর নেতৃত্বে আরবে ওয়াহাবি আন্দোলনের সূচনা হয়। ভারতে রায়বেরিলির সৈয়দ আহমদ ওয়াহাবি আন্দোলন পরিচালন করে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। বাংলায় বারাসাত অঞ্চলের তিতুমির নামে পরিচিত মির নিসার আলি নারকেলবেড়িয়া অঞ্চলে ওয়াহাবি আন্দোলন শুরু করে তা নদিয়া, ফরিদপুর প্রভৃতি স্থানে ছড়িয়ে দেন। নারকেলবেড়িয়ায় তিতুমির স্থানীয় অত্যাচারী জমিদার, নীলকর ও ব্রিটিশ প্রশাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ডাক দেন। একটি বাঁশের কেল্লা বানিয়ে তিনি নিজেকে বাদশাহ রূপে ঘোষণা করেন। ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ বাহিনী কামান দিয়ে ওই বাঁশের কেল্লা ধ্বংস করে ও তিতুমিরকে হত্যা করে।


* ফরাজি আন্দোলন : 

পূর্ববাংলার অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশের ফরিদপুর অঞ্চলে হাজি শরিয়ত উঙ্গা গরিব চাষিদের নিয়ে ফরাজি আন্দোলন গড়ে তোলেন। তিনিও জমিদার, নীলকর ও ঔপনিবেশিক প্রশাসনের তীব্র বিরোধিতা করে ঊনবিংশ শতকের শেষ দিক পর্যন্ত ফরাজি আন্দোলন চালিয়েছিলেন।


★ মুণ্ডা উলগুলান : 

১৮৯৯-১৯০০ খ্রিস্টাব্দে উপজাতীয় কৃষক বিরসা মুণ্ডার নেতৃত্বে মুন্ডা উলগুলান বা মুন্ডা বিদ্রোহ ঘোষিত হয়। জমিদার, মহাজন, খ্রিস্টান মিশনারি ও ঔপনিবেশিক সরকারের বিরুদ্ধে মুণ্ডা কৃষকরা বিদ্রোহী হয়। উপনিবেশিক প্রশাসন নিষ্ঠুর দমনপীড়নের মাধ্যমে মুন্ডা বিদ্রোহ আয়ত্তে আনে।


• নীলবিদ্রোহ ঃঃ

 বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস এবং দিগম্বর বিশ্বাসের নেতৃত্বে ১৮৫৯-৬০ খ্রিস্টাব্দে নীলবিদ্রোহ সংগঠিত হয়। এতে অসংখ্য শিক্ষিত মানুষের সমর্থন ছিল। ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে দীনবন্ধু মিত্র তাঁর 'নীলদর্পণ' নাটকে নীলকরদের অত্যাচারের কথা তুলে ধরেন। এ ছাড়া নীলবিদ্রোহের পক্ষে সমর্থন জানায় খ্রিস্টান মিশনারি রেভারেন্ড জেমস লং, হিন্দু প্যাট্রিয়ট ও সোমপ্রকাশ পত্রিকা। ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে নীলবিদ্রোহ শেষ হয় এবং নীলচাষও বন্ধ হয়ে যায়।


 নীলবিদ্রোহ ও হিন্দু প্যাট্রিয়টঃ

 বংলার নীলবিদ্রোহে সহমর্মী ছিলেন হিন্দু প্যাট্রিয়ট সংবাদপত্রের সম্পাদক হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি লেখেন যে, | নীলচাষ একটি সংগঠিত জুয়াচুরি ও নিপীড়ন-ব্যাবসা মাত্র। নীলচাষ একবার যে শুরু | করেছে তার আর মুক্তি নেই। সে লাভের চেয়ে ক্রমাগত ক্ষতিতেই নিঃশেষিত হয়। | হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় তাঁর পত্রিকায় শিশিরকুমার ঘোষ ও মনমোহন ঘোষকে দিয়ে নীলচাষের খবরাখবর লিখিয়ে বাংলায় শিক্ষিত জনগণের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন।


• ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ :

 অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকেই ব্রিটিশ কোম্পানি সেনাবাহিনীতে নানান রকম জাতিপরিচয়কে উসকে দিলেও পরবর্তী সময়ে অর্থাৎ ১৮২০-এর দশক থেকে জাতিগত সুযোগ-সুবিধা বন্ধ করে দিয়ে তারা সেনাবাহিনীকে একই ছাঁচে ঢালার চেষ্টা করে। ফলে সেনাবাহিনী ক্ষুদ্ধ হয়। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের গোড়ার দিকে কলকাতার দমদম সেনাছাউনিতে গুজব ছড়ায় নতুন এনফিল্ড রাইফেলের টোটাগুলিতে নাকি গোরু ও শুকরের চর্বি মেশানো রয়েছে। ওই টোটাগুলি রাইফেলে ভরার আগে দাঁত দিয়ে কেটে নিতে হত। সারাদেশের সেনাছাউনিতে দ্রুত এই গুজব ছড়িয়ে পড়ে। সতর্ক হয়ে ব্রিটিশ কোম্পানি টোটা বানানো বন্ধ করে দেয়।

১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসের শেষ দিকে ব্যারাকপুরের সেনাছাউনির সিপাহি মঙ্গল পান্ডে জাত ও ধর্ম নষ্টের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে ইউরোপীয় এক সেনা আধিকারিককে গুলি করে। তৎক্ষণাৎ তাকে ও তার সমর্থনকারী কয়েকজন সিপাহিকে গ্রেপ্তার করে ফাঁসির আদেশ দিলে দেশের সমস্ত সেনাছাউনিতে খবরটা ছড়িয়ে পড়ে। আম্বালা, লখনউ, মিরাট প্রভৃতি অঞ্চলে শুরু হয়ে যায় ব্রিটিশ কোম্পানির বিরুদ্ধে সেনাদের বিদ্রোহ।


গোরে আয়ে :

 ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের ১০ মে। তখন বিকাল প্রায় শেষ। স্থান উত্তরপ্রদেশের মিরাটের সেনাছাউনি। কাছেই বাজার। বাজারে বসে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দেশীয় সিপাহিরা স্থানীয় মানুষগুনের সঙ্গে আলোচনা করছিল। আগের দিন কলোনেল কারমাইকেল স্মিথ ৮৫ জন সিপাহিকে জেলের মধ্যে শিকল বেঁধে। রেখেছে। তাদের অপরাধ এনফিল্ড রাইফেলে তারা কার্তুজ ভরেনি। ওই সময়ে ওই ছাউনির শেতাঙ্খা সৈনিকরা প্যারেড করে চার্চে প্রার্থনার জন্য যাচ্ছিল। এই সময় ভয়ে একটি অল্পব্যাস্ত ছোলে 'গোরে আরে, গোরে আসে' বলে ঊর্ধ্বশ্বাসে বাজারের দিকে ছুটে গেলে ভুল বুঝে বাজারে থাকা উত্তেজিত দেশীয় সিপাহিরা তৎক্ষণাৎ সেনা ছাউনির অস্ত্রাগারের দখল নিল। তাদের সঙ্গে স্থানীয় অনেক বিক্ষুদ্ধ মানুস যোগ দিয়ে। গোরা সিপাহিদের হত্যা করল। মিরাটে শুরু হল সিপাহি বিদ্রোহ।


মিরাটের সিপাহিরা তাদের বন্দি সিপাহিদের মুক্ত করে ইউরোপীয় সেনা আধিকারিকদের হত্যা করে। তারপর সম্মিলিতভাবে দিল্লি পৌঁছে মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরকে 'হিন্দুস্থানের সম্রাট' ঘোষণা করে। এই খবর উত্তর-পশ্চিম প্রদেশ ও অযোধ্যার সেনাছাউনিতে পৌঁছে গেলে সেখানকার দেশীয় সিপাহিরা বিদ্রোহ করে। তাদের সঙ্গে সাধারণ জনগণও যোগ দেয়। তবে মাদ্রাজ ও বোম্বাই বাহিনীর সিপাহিরা বিদ্রোহে সাড়া দেয়নি। পঞ্জাবি ও গুর্খা সিপাহিরা বিদ্রোহী সৈন্যদের দমনে তৎপর হয়। শুধুমাত্র বেঙ্গাল আর্মির সিপাহিরা এই বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়েছিল। বোল আর্মির বেশির ভাগ সৈনিকই বেতন কম পাওয়া দরিদ্র কৃষক পরিবারের সন্তান। তবে বাংলা ও পদ্মাবের মানুষজন ব্রিটিশ শাসনের সুফল লাভ করত বলে তারা বিদ্রোহে যোগ দেয়নি। শিক্ষিত বাঙালি সমাজের অনেকেই এই বিদ্রোহের নিন্দা করেছেন।




+ ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ এক বাঙালি সরকারি চাকুরের চোখে দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা 'বিদ্রোহে বাঙ্গালী' গ্রন্থ থেকে জানা যান, জনৈক বাঙালি সরকারি চাকুরে লিখেছেন, দূরের একদল সৈন্যের 'খবরদার গোরে আছে' চিৎকারে মুহূর্তেই লিলিদি‍ জ্ঞানশূন্য হয়ে সকলেই 'গোরে আছে, গোলে আগে বালে চিৎকারে যোগ দিল। চিৎকারে পৃথিবী ভরে গেল। এটি চিৎকারে গোরা অর্থনৈ এসেছে শুনে এই বাঙালি বাবুটি আনন্দ অনুভব করেছিলেন।

পুরো দক্ষিণ ভারতই এই বিদ্রোহে সাড়া দেয়নি। বিদ্রোহে যোগদানকারী অসামরিক মানুষদের মধ্যে ছিল সুযোগ-সুবিধা না পাওয়া বেশ কিছু সামন্তপ্রভু ও জমিদার, আর জমি হারানো কৃষকের দল। বিদ্রোহ চলাকালে হিন্দু-মুসলমান ঐক্য ছিল অটুট। প্রকৃতপক্ষে বিভিন্ন অসন্তোষ ও বঞ্চিতদের পুথিত তীব্র ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ মিলেমিশে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের এই বিদ্রোহ গণঅভ্যুত্থানের রূপ ধারণ করেছিল।


চার্টে বিদ্রোহগুলির ছোটো ছোটো ইতিহাসও লিখে রাখো। উঃ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন বিদ্রোহগুলি হল— ১৮৫৫-১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দের সাঁওতাল হল, মালাবারের মোপালা বিদ্রোহ, ফরাজি আন্দোলন, | ১৮৯৯-১৯০০ খ্রিস্টাব্দের মুন্ডা বিদ্রোহ, ওয়াহাবি আন্দোলন ও বারাসাত বিদ্রোহ, ১৮৫৯-১৮৬০-এর নীলবিদ্রোহ, ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের সিপাহি বিদ্রোহ ইত্যাদি । ওপরের প্রশ্নের পরবর্তী উত্তর তোমরা এই বই থেকে অথবা পাঠ্যপুস্তক থেকে পড়ে কথা তোমাদের উত্তরপত্রে লিখে নাও।




সিপাহি বিদ্রোহ না জাতীয় বিদ্রোহ :

 ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের চরিত্র নিয়ে ঐতিহাসিক কিংবা গবেষক কিংবা রাজনৈতিক বিশ্লেষণকারীদের মধ্যে বিতর্কের শেষ নেই। অধিকাংশ ব্রিটিশ ভাষ্যকারের মতে, সিপাহিদের বিদ্রোহের সঙ্গে সাধারণ জনগণের অসন্তোষও মিশে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিল। কিন্তু ব্রিটিশ পার্লামেন্টে একে | নিছক সেনা বিদ্রোহ না ভেবে এটা জাতীয় বিদ্রোহের রূপ নিচ্ছে কিনা আলোচনা | হয়েছিল। কার্ল মার্কস একে 'জাতীয় বিদ্রোহ' বলেছিলেন। এই বিদ্রোহকে জাতীয়তাবাদীরা 'ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধ' বললেও মেনে নেওয়া যায় না আবার 'সিপাহি বিদ্রোহ' বললেও এতে বিদ্রোহের সামগ্রিক রূপ ধরা পড়ে না।


একটা বিষয়ে অবশ্য নিশ্চিত হওয়া যায় যে, বিদ্রোহীরা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনকে উৎখাত করতে চেয়ে সকলে ঐক্যবদ্ধ করতে চেয়েছিল। অনেক সামন্তপ্রভু এবং জমিদারও কিছুটা পরিস্থিতির চাপে পড়ে জনগণের বিদ্রোহে যোগ দেয়। এমনকি মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর, ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাই এবং নানা সাহেবকেও সিপাহিরা বিদ্রোহের অংশীদার হতে বাধ্য করেছিল। ব্রিটিশ কোম্পানি অবশ্য চূড়ান্ত দমনপীড়নের মাধ্যমে বিদ্রোহ শান্ত করে। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের শেষের দিকে ব্রিটিশ শাসক দিল্লি পুনর্দখল করে বাহাদুর শাহ জাফরকে রেঙ্গুনে নির্বাসন দেয়।




* বাহাদুর শাহ জাফর-এর বিচার :

 মুঘল বাদশার লালকেল্লার দেওয়ান-ই ঘাসে বসে শাসন চালাতেন। সেখানেই ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দের ২৭ জানুয়ারি শেষ মুঘল বাদশাহ ৮২ বছরের বৃন্দ বাহাদুর শাহ জাফরের বিচার হয়। দীর্ঘ প্রায় দেড়ঘণ্টা তাকে দাঁড় করিয়ে ঘৃণ্য অপমানজনক বিচার করে এই শেষ মুগল বাদশাহকে ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দের ২৯ মার্চ বন্দি করে বার্মার রেঙ্গুনে পাঠানো হয়।



ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক প্রশাসনের ভয়ংকর দমনপীড়ন সত্ত্বেও যে বিদ্রোহ একেবারেই নির্মূল হয়েছিল তা বলা যায় না। ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দের গোড়ার দিকে উত্তর ও মধ্য ভারতের বিভিন্ন অংশে সম্পদহীন, লোকবলহীন, উপযুক্ত অস্ত্রশস্ত্রহীন বিদ্রোহীদের ব্রিটিশ সেনারা পরাজিত করে। তা ছাড়া বিদ্রোহীদের সকলে দিল্লিত জড়ো হওয়ায় ব্রিটিশ কোম্পানির পক্ষে অনায়াসে বিদ্রোহ দমন করে দিল্লি পুনর্দখল করা সহজ হয়ে যায়।



* ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ কলকাতার অভিজ্ঞতা : পাঠ্যাংশে উদ্ধৃত অংশটি | শিবনাথ শাস্ত্রীর 'রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ' গ্রন্থ থেকে মূল বানান অপরিবর্তিত রেখে নেওয়া হয়েছে। গৃহীত ওই উদ্ধৃতির সারকথা হল—


১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে কলকাতায় মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ল যে, বিদ্রোহী সিপাহিরা কলকাতায় এসে সমস্ত ইংরেজদের হত্যা করে শহর লুট করবে। এই ভয়ে ইংরেজরা কেন্নায় আশ্রয় নিল আর দেশীয় জনগণ এমনই সন্ত্রস্ত হল যে নিজের ঘরের দরজা বল করে ভিতরে বসে এ বিষয়ে এতটুকু আলোচনা করতেও সাহস হল না। নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থে খ্রিস্টানরা অস্ত্রশস্ত্র হাতে রাস্তাঘাটে বেরোতে লাগল। সন্ধ্যার পর বাজার বন্ধ হল, প্রয়োজনীয় জিনিস পাওয়া গেল না। গড়ের মাঠের পাশের রাস্তা দিয়ে রাত্রিতে কেউ ইটিলে অনুধারী গ্রহনী তাকে 'হুকুমনার' অর্থাৎ who comes there? (কে আসছে) প্রশ্ন করত। উত্তরে 'রাইয়ত হ্যায়' অর্থাৎ 'আমি জা বলে নিষ্কৃতি পেতে হত। এভাবে সকল শ্রেণির মধ্যে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের মারাত্মক ভীতি প্রবেশ করে কাউকে স্থির থাকতে দেয়নি।

১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ সামলে উঠলে ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন মুছে দিয়ে ব্রিটেনের পার্লামেন্ট শাসনক্ষমতা সরাসরি নিজেদের হাতে তুলে নেয়। আইন জারি করে ব্রিটেনের রানি ভিক্টোরিয়াকে ব্রিটিশ ভারতের সম্রাজ্ঞী ঘোষণা করা হয়। আর এদেশের শাসন তত্ত্বাবধানে রানির মন্ত্রীসভার এক সদস্যকে সচিব নাম দিয়ে পাঠানো হয়। গভর্নর জেনারেল পদ উঠিয়ে দিয়ে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে গভর্নর জেনারেল লর্ড ক্যানিংকে ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দের ১ নভেম্বর প্রথম ভাইসরয় নিযুক্ত করা হয়। এভাবে ভারত শাসন আইন ও মহারানি ভিক্টোরিয়ার শাসন শুরু হয়।





About the Author

Hello Friends, welcome to our website Daily GK Career , founded on 27 April 2023 by Sandip Sanki. Daily GK Career is a free professional Education platform where we provide Free online mock test, govt exam, WBCS, RAIL, GROUP D, BANK, POST Office, …

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp Group Join Now
Telegram Group Join Now
Cookie Consent
We serve cookies on this site to analyze traffic, remember your preferences, and optimize your experience.
Oops!
It seems there is something wrong with your internet connection. Please connect to the internet and start browsing again.
AdBlock Detected!
We have detected that you are using adblocking plugin in your browser.
The revenue we earn by the advertisements is used to manage this website, we request you to whitelist our website in your adblocking plugin.
Site is Blocked
Sorry! This site is not available in your country.