অষ্টম শ্রেণীর ইতিহাস |
সপ্তম অধ্যায় | ভারতের জাতীয় আন্দোলনের আদর্শ ও বিবর্তন
{tocify} $title={Table of Contents}
ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের আন্দোলন শেষ পর্যন্ত সত্য সত্যই গণআন্দোলনে রূপান্তরিত হল। সেটা ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দ। ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধি ভারতের জাতীয় কংগ্রেসে যোগ দিয়েছেন। এই পাঁচ বছরেই তিনি সমগ্র ভারতবাসীর হৃদয় জয় করে নিয়েছেন। ফলে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দ ও তার পরবর্তী দিনগুলিতে গান্ধির নেতৃত্বে জাতীয় কংগ্রেস পরিচালিত ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনগুলি ক্রমেই গণআন্দোলনে রূপান্তরিত হতে থাকে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪-১৯১৯ খ্রিঃ) চলাকালীন সময়েই গান্ধি আফ্রিকা থেকে স্বদেশে ফিরে এসে জাতীয় কংগ্রেসে যোগদান করেছিলেন।
• মহাত্মা গান্ধি :
অহিংস সত্যাগ্রহ ও স্বরাজ ভাবনা : ভারতবর্ষে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার আগে গান্ধি দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণ-বৈষম্য-বিরোধী যে আন্দোলন চালিয়েছিলেন সেই আন্দোলনে প্রচার পাওয়ার ফলে গান্ধি বিখ্যাত হয়ে উঠেছিলেন। সেই সময় ভারতের বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা মূলত এক একটি অঞ্চলেই জনপ্রিয় ছিলেন। কিন্তু ভারতে এসে কংগ্রেসের আন্দোলনে যোগ দিয়ে গান্ধি দক্ষিণ আফ্রিকার আন্দোলনের সুবাদে শুরু থেকে তাঁর সর্বভারতীয় স্বচ্ছ ভাবমূর্তি তৈরি করতে পেরেছিলেন। গান্ধি মনে করতেন সত্যের খোঁজ করাই মানবজীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য। গান্ধির 'সত্যাগ্রহ' ও 'অহিংসার’ আদর্শ দুটি পরস্পর সম্পর্কিত। এই দুটিকে একসঙ্গে অহিংসা সত্যাগ্রহ বলা হয়। অর্থাৎ, আন্দোলনে অধিকাংশ জনগণকে টেনে আনার মাধ্যমেই 'অহিংস সত্যাগ্রহ' সফল হবে।
* ভারতের ওপর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব :
১৯১৪ থেকে ১৯১৯ পর্যন্ত সংঘঠিত প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল ভারতসহ এশিয়া ও ইউরোপের অসংখ্য দেশ। তখন সেই যুদ্ধে অসংখ্য ভারতীয় সৈন্য মারা গিয়েছিল। কম খাদ্যশস্য উৎপাদন, যুদ্ধের খাতে অপরিমের খরচের দরুন এবং ১৯১৮-১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে দুর্ভিক্ষ ও সংক্রামক ব্যাধির কারণে ভারতের কয়েক লক্ষ মানুষ মারা যায় ।
মন্টেগু-চেমসফোর্ড সংস্কার ও প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সরকার যে প্রতিশ্রুতি ভারতীয়দের দিয়েছিল তা তারা পালন করেনি। ফলে স্বশাসন বা Home Rule | Movement প্রবল হয়ে ওঠে। বাধ্য হয়ে ভারতসচিব মন্টেগু এবং লর্ড চেমসফোর্ড ভারত শাসন আইন পাশ করে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারের মধ্যে ক্ষমতা ও দায়িত্ব ভাগ করে দেন। কিন্তু এতে ভারতবাসীর কোনো লাভই হয়নি।
গান্ধির স্বরাজ ভাবনা :
১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে হিন্দ স্বরাজ নামের একটি রচনায় গান্ধি বলেছেন, পাশ্চাত্য আদর্শভিত্তিক আধুনিক শিল্পসমাজই ভারতের সাধারণ মানুষের শত্রু। তাঁর মতে, কেবল রাজনৈতিকভাবে স্বরাজের দাবি অর্ধেক স্বাধীনতার দাবি। অর্থাৎ ঔপনিবেশিক শাসনের হাত ধরে ভারতবর্ষের চিরকালীন ঐতিহ্য অনুসারে ভারতবাসীকে সহজ-সরল জীবনযাপন করতে হবে। যে পাশ্চাত্য রুচি ও চিন্তাভাবনা ঢুকেছে তা ত্যাগ করতে বলেছেন ভারতবাসীকে। তাই তিনি যন্ত্র-নির্ভর আধুনিক সভ্যতা দূর করতে চেয়ে খানির পোশাক ও চাকা কাটার কর্মসূচি নিয়েছিলেন।
গান্ধির ওই পাশ্চাত্য ও যন্ত্র-নির্ভর সভ্যত্যা-বিরোধী উক্তি সকলের কাছে সমর্থিত হয়নি। কারণ সংবাদপত্র ও রেল ব্যবস্থার সুযোগ নিয়েও গান্ধির নিজের মুখে যন্ত্র-সভ্যতার প্রতি তাচ্ছিল্য ভীষণ বেমানान
+ চরকা প্ৰসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথের 'স্বরাজ্যাধন' প্রবন্ধ থেকে গৃহীত পাঠ্যাংশ উদ্ধৃত লেখাটির সারকথা হল, আমাদের দেশের নেতারা স্বরাজের সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা করেননি। স্বাধীনতা শব্দের অর্থ বিস্তৃত। নিজের চরকায় নিজের সুতো কাটার স্বাধীনতা আমাদের আছে। কিন্তু কলের সুতোর সঙ্গে সেই সুতো পামা দিতে পারবে না। তা ছাড়া দেশে সকালে মিলে চরকা চালালে অর্থকষ্ট কিছু দূর হতে পারে, কিন্তু তাকেও স্বরাজ বলা যায় না। মহাত্মা গান্ধির ব্যক্তিগত মাহাত্ম্যের ওপরে দেশবাসীর যে শ্রদ্ধা আছে তাতে তারা দীর্ঘকাল চরকা কাটা কাজকেই স্বরাজ মনে করবে। আমি মনে করি, এরকম মতি স্বরাজের পক্ষে ভালো নয়।
হাঁটুর ওপর কাপড় পরে, সরল ভাষায় কথা বলে, গান্ধি জনগণের খুব কাছাকাছি যেতে পেরেছিলেন। তুলসীদাসী রামায়ণ বা রামরাজ্য প্রভৃতি প্রতীক ব্যবহার করে তিনি উত্তর ও মধ্যভারতের হিন্দুজনগণের কাছে প্রিয় মানুষ হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু অসংখ্য অ-হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা তেমন একটা হয়নি।
* গান্ধি ও গুজব গান্ধিজিকে কিছু মানুষ ভাবত সাধুর মতো, কিছু মানুষ ভাবত দেবতার মতো, কিছু মানুষ ভারত গান্ধিজির নাম নিলে পুলিশের গুলিও কোনো ক্ষতি করতে পারেব না। এসব গুজব ও জনশ্রুতি গান্ধিজির আন্দোলনে জনগণকে টেনে এনেছিল। অবশ্য অনেক ক্ষেত্রেই ওইসব আন্দোলন গান্ধির ঘোষিত মত ও পথের বাইরে এমনকি বিরোধী হয়ে পড়েছিল।
মহাত্মা গান্ধির নেতৃত্বে তিনটি আঙুলিক আন্দোলন : দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে গান্ধি ভারতে ফেরেন ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে। এর পরবর্তী তিন বছরে গান্ধি বিহারের চম্পারন,
গুজরাটের খেড়া জেলায় এবং আমেদাবাদে তিনটি আন্দোলনে নেতৃত্ব দিলেও ১৯১১ খ্রিস্টাব্দের ঘোড়ার দিক পর্যন্ত সর্বভারতীয় রাজনীতিতে গান্ধির ভূমিকা জোরদার হয়নি। চম্পারনে নীলচাষিদের বিক্ষোভ আন্দোলনে স্থানীয় কিছু ব্যবসায়ী, শিক্ষক প্রভৃতি নেতৃত্বে দিলেও সেখানে গান্ধির নেতৃত্ব ছিল রামায়ণের রামের মতো। তারা মনে করত গান্ধি এসে যাওয়ায় ঠিকা চাষি আর রাক্ষস কুঠিয়ালদের ভয় করবে না। কিন্তু এই আন্দোলন কিছু ক্ষেত্রে অহিংস সত্যাগ্রহের নীতিকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। গুজরাটের খেড়া জেলায় কৃষকদের বাড়তি রাজস্ব কমানোর দাবিতে গান্ধি সামান্য সাফল্য পেয়েছিলেন। এরপর আমেদাবাদে মিল মালিক ও শ্রমিকদের সংঘাতে শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলনে গান্ধি অনশন করেও মজুরি খানিক বৃদ্ধি করতে পেরেছিলেন। কিন্তু রাওলাট আইন চালু করাকে কেন্দ্র করে গান্ধি সর্বভারতীয় স্তরে আন্দোলনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন।
• রাওলাট সত্যাগ্রহ ও জালিয়ানওয়ালাবাগের ঘটনা :
১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের মার্চে এস. এ. টি. রাওলার্টের নেতৃত্ব কমিটিতে আনীত দুটি বিলের জন্য বিপ্লবী আন্দোলন ঠেকাতে ব্রিটিশ সরকার দমনমূলক অতিরিক্ত আইনি ক্ষমতা পেয়েছিল। ওই বছরই ৬ এপ্রিল সাধারণ ধর্মঘটের মাধ্যমে জাতীয় স্তরের আন্দোলনে গান্ধি নেতৃত্ব দিলে তাকে জেলে নিয়ে যাওয়ায় হিংসাশ্রীী আন্দোলনের সৃষ্টি হয়। ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ১৩ এপ্রিল পঞ্চারের অমৃতসরের জালিয়ানওয়ালাবাগে অসংখ্য মানুষ নিবন্ধ প্রতিবাদে মিলিত হয়েছিলেন। জালিয়ানওয়ালাবাগ থেকে বেরোনোর রাস্ত। ছিল মাত্র একটি। সেই পথ আটকে রেখে পুলিশ গুলি চালিয়ে অসংখ্য প্রতিবাদী মানুষকে হতাহত করে। এই চরম নৃশংস হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে সমগ্র ভারতবাসী তীব্র ধিক্কার জানিয়েছিল। গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ স্যার উপাধি বা নাইট উপাধি বিসর্জন দিয়ে ব্রিটিশ সরকারের ওই আচরণে তীব্র ঘৃণা জানিয়েছিলেন।
← খিলাফৎ আন্দোলন :
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে গ্রেট ব্রিটেন তুরস্ককে আক্রমণ করে তুরস্কের সুলতানকে ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে ক্ষমতাচ্যুত করে। তুরস্কের এই সুলতান আবার ছিলেন। ইসলাম জাতের ধর্মগুরু বা গলিফা। এতে ভারতীয় মুসলমানরা ভীষণ ক্ষু হয়। ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে মহাত্মা গান্ধির নেতৃত্বে মুসলিম লিগের কিছু নেতা খলিফার মর্যাদা ও সম্মান রক্ষার জন্য খিলাফৎ আন্দোলন গড়ে তোলেন।
• অহিংস অসহযোগ থেকে ভারত ছাড়ো আন্দোলন :
মহাত্মা গান্ধির বিক্ষোভ প্রদর্শনের বিবর্তনঃ খিলাফৎ আন্দোলনের সূত্র ধরে গান্ধি ভারতের হিন্দু ও মুসলমানদের একজোট করে গাদি ব্রিটিশ-বিরোধী তীব্র আন্দোলনের চেষ্টা করলেন। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি খিলাফৎ আন্দোলনের রেশ ধরে তিনি অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের ডাক নিলেন। এই আন্দোলনে শ্রমিক-কৃষক, নারীপুরুষসহ স্কুল-কলেজের ছাত্ররাও যোগ দেয়। অনেক আইনজীবী এবং সরকারি কর্মচারী পদত্যাগ করে এই আন্দোলনে যোগ দেয়। কিন্তু বিদেশি দ্রব্য বয়কট এবং বিদেশি কাপড় প্রকাশ্যে পোড়াতে গিয়ে জনগণ যেভাবে উগ্র ও হিংস্র মূর্তি ধারণ করে তাতে গান্ধি আন্দোলন তুলে নেন।
* চৌরিচৌরার ঘটনা :
অসহযোগ আন্দোলনে হিংসার চূড়ান্ত প্রকাশ দেখা যায় উত্তরপ্রদেশের গোরক্ষপুর জেলার চৌরিচৌরা গ্রামে। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ৪ ফেব্রুয়ারি। ওই গ্রামের জনগণ প্রতিবাদ জানাতে সমবেত হলে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধে। | উন্মত্ত জনতার ভয়ে পুলিশরা থানায় ঢুকে পড়লে দরজা বন্ধ করে জনতা আগুন লাগিয়ে দেয়। বাধ্য হয়ে গান্ধি ওই অহিংস আন্দোলন উঠিয়ে নিয়েছিলেন। অবশ্য তাঁর এই সিদ্ধান্তে জাতীয় কংগ্রেসের অনেক নেতা গান্ধির সমালোচনা করেছিলেন।
নিজে করো তোমার স্থানীয় অঞ্চলে কোনো বয়ন্ত মানুষ স্বাধীনতা আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন কিনা খোঁজ করো। থাকলে তার/তাঁদের অভিজ্ঞতার একটি সাক্ষাৎকার নাও। পাশাপাশি স্থানীয় অঞ্চলে তোমার ব্যাসি ছেলেমেয়েরা স্বাধীনতা আন্দোলন বিষয়ে কী কী জানো তার একটি সমীক্ষাপত্র তৈরি করো।
উত্তর ঃ হ্যাঁ, আমি আমার অঞ্চলে অর্থাৎ কলকাতার মানিকতলায় একজন মানুষকে জানি, যিনি স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নিয়েছিলেন। তাঁর নাম শ্রী শচীন্দ্রনাথ গুহ। তাঁর বয়স এখন প্রায় একশো বছরের কাছাকাছি। তিনি জন্মেছিলেন বর্তমান বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার জাজিতপুর গ্রামে। তিনি দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে তাঁর বাবার সঙ্গে কলকাতায় চলে আসেন। আমি তাঁর যে সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম তা এইরকম- আমি শচীনবাবু, আপনি আমার প্রণাম নেবেন।
শচীনবাবু দীর্ঘজীবী হও।
আমি-আমি আপনার মেজো ছেলে অমিতাভবাবুর কাছে স্বাধীনতা আন্দোলনে আপনার অংশগ্রহণ করার কথা শুনলাম। শচীনবাবু (ক্ষীণ হেসে কয়েক মুহূর্ত থেমে দীর্ঘনিশ্বাস মোচন করে) হ্যাঁ, সে আজ
প্রায় সত্তর বছর আগের কথা। তখন সবে আমি ট্রিপ্ল এম.এ পরীক্ষায় পাশ করেছি। দেশমাতার শৃঙ্খলমোচনের দাবিতে আন্দোলনে নেমে হাজার হাজার মানুষ চাকরি ছেড়ে দিচ্ছে জেনে আমিও আর চাকরীর চেষ্টা করলাম না। ঝাপিয়ে পড়লাম স্বাধীনতা আন্দোলনে। সেই কাজে যেন এক চরম আনন্দ অনুভব করলাম। নিজের জীবনকে ধন্য মনে করলাম। মাস ছয়েক পরে পুলিশ ধরে আমাকে জেলে পুরে দিল।
আমি কেন? হিংসাশ্রয়ী উপায় নিয়েছিলেন নাকি? শচীনবাবু-না না। আমি আজীবন গান্ধিজির অহিংস সত্যাগ্রহে বিশ্বাসী ছিলাম। আমি তবে কীরকম ঘটনায় আপনি পুলিশের চোখে শত্রু হয়ে গেলেন? শচীনবাবু—তুমি বোধহয় তোমাদের ইতিহাসে পড়েছ তমলুক মহকুমায় ১৯৪০-এর দশক নাগাদ তালিখ আতায় সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
আমি — হ্যাঁ পড়েছি। সতীশচন্দ্র সামন্ত মহাশয়ের নেতৃত্বে। | শচীনবাবু ঠিক বলেছ। আমার খুব মনে আছে, ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ৮ সেপ্টেম্বরের পর তমলুক, মহিষাদল, নন্দীগ্রাম, ভগবানপুর প্রভৃতি অঞ্চলে যোগাযোগ ব্যবস্থা | ভেঙে দেওয় হয়। সেই আন্দোলনে আমি জড়িয়ে পড়েছিলাম। পুলিশ আমাকে। মেদিনীপুর সদর জেলে ৩ মাস ১১ দিন বন্দি করে রেখেছিল। আমি-আপনি কলকাতার লোক হয়ে মেদিনীপুর গ্রামে গেলেন কীভাবে?
শচীনবাবু (গর্বের হাসি হেসে) – আরে বাছা! স্বদেশি মন্ত্রে যারা দীক্ষা নিয়েছিল তাঁ সমগ্র ভারতবর্ষটাকেই নিজের ঘর বলে জেনেছিল। তোমরা আজকালকার ছেলে। তোমাদের মধ্যে দেশপ্রেম বলতে কী বোধ আছে জানি না। তবে তখন আমাদের কাছে। বাংলার চট্টগ্রাম বলো আর পশ্চিম ভারতের লাহোর বলো একটাই দেশ। আমাদের মাতৃভূমি ভারতবর্ষ। যে ভারতবর্ষের আলো, বাতাস, জল আমাদের দেহমনকে পুষ্ট করে রেখেছে সেই মাটিতেই আমার জন্ম। (বলতে বলতে কয়েক মুহূর্ত থেমে গেলেন, | তারপর ওই রবীন্দ্রনাথের জাতীয় সংগীতে কী পড়েছ তোমরা ?....... পাঞ্জাব সিন্ধু গুজরাট মারাঠা দ্রাবিড় উৎকল বা বিন্ধ্য হিমাচল.....
আমি শচীনবাবু, আমি জানতে চাইছি তারপরের ঘটনা কী হল ? শচীনবাবু — তুমি অন্য একদিন এসো বাছা । ... এখন আমার ওষুধ খাওয়ার সময় দেরি হলে আমার মেজছেলে গোবিন (অমিতাভ) আমাকে বকাবকি করবে।
অসহযোগ আন্দোলনের ফলে ভারতে কাপড় আমদানি কমে গিয়েছিল। অহিংস অসহযোগ আন্দোলন ভারতের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েনি। অহিংস আন্দোলনের পর বেশ কয়েক বছর গান্ধি ছিলেন জেলে বন্দি। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে তিনি আদর্শ সত্যাগ্রহী কর্মী তৈরির উদ্যোগ নিয়েছিলেন। অন্যদিকে কংগ্রেস সংগঠনের মধ্যেও নতুন করে বিবাদ দেখা দেওয়ায় কংগ্রেসের মধ্যে স্বরাজ্যপন্থী নামে একটি নতুন গোষ্ঠী আত্মপ্রকাশ করেছিল।
স্বরাজ্য দল :
১৯২২ খ্রিস্টাব্দের শেষ নাগাদ গান্ধির পন্থা থেকে বেরিয়ে এসে চিকনগুন দাশ ও মোতিলাল নেহরু কংগ্রেস-খিল করা হল গড়ে তোলেন। তবে তারা আলাদা কর্মসূচি নিলেও গান্ধির পরামর্শ মতো কংগ্রেসের মধ্যেই থেকে একটি স্বতন্ত্র গোষ্ঠী হিসেবে কাজ করতে থাকে। ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে চিত্তরঞ্জন দাশ মারা গেলে গোষ্ঠীগুলি আবার এক হয়ে যায়।
১৯২৭ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে ভারতীয়দের সাংবিধানিক অধিকার খতিয়ে দেখার জন্য স্যর জন সাইমনের নেতৃত্বে ব্রিটিশ প্রশাসন একটি কমিশন গঠন করে। কিন্তু ওই কমিশনে কোনো ভারতীয় সদস্য না থাকায় ভারতের সমস্ত রাজনৈতিক সংগঠন একযোগে গণআন্দোলন গড়ে তোলে। দেশজোড়া বিভিন্ন হরতালে কমিশনকে কালো পতাকা দেখিয়ে আওয়াজ তোলা হয় 'সাইমন ফিরে যাও'। সাইমন-কমিশন-বিরোধী উদ্যোগগুলির ফলে ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের ৬ এপ্রিল গান্ধির নেতৃত্বে পূর্ণ স্বরাজ অর্জনের কথা ঘোষণা করে কংগ্রেস।
আইন অমান্যের ডাক দিয়ে ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ৬ এপ্রিল গুজরাটের ডান্ডিতে অভিযান করে গান্ধি লবণ আইন ভঙ্গ করেন। সমুদ্রের তটভূমি থেকে একমুঠো লবণ তুলে গান্ধি প্রতীকীভাবে ভারতবর্ষে ঔপনিবেশিক শাসনকে অস্বীকার করেন। দেশজুড়ে ব্যাপক আইন অমান্য আন্দোলনে যোগ দিয়ে কৃষকরাও রাজস্ব দিতে অস্বীকার করে।
ভারতের উত্তর-পশ্চিম ও পূর্ব অঞ্চলে আইন অমান্য আন্দোলন ও ভারতের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তের অহিংস গান্ধিবাদী সংগ্রামী নেতা আবদুল গফ্ফর খানের ডাকে পাঠানরা আইন অমান্য আন্দোলন করে। সীমান্ত গান্ধি নামে জনপ্রিয় ওই গান্ধি। অনুরাধী নেতা পুদা-ই-খিদমদার বা লালকুণ্ডা বাহিনী নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। পেশোয়ারে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সিপাহিরা অহিংস আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালাতে অস্বীকার করে। মণিপুরি ও নাগারাও আইন অমান্য আন্দোলনে সাড়া দেয়। নাগা অঞ্চলে তরুণী রানি গিদালো ব্রিটিশ-বিরোধী বিদ্রোহের জন্য গ্রেফতার হন। ১৯৩০-এর দশকে মৌলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানির নেতৃত্বে সিলেট, মৈমনসিংহ অঞ্চলে কৃষক আন্দোলন সংগঠন গড়ে ওঠে।
+ গান্ধি-আরউইন চুক্তি :
১৯৩১ খ্রিস্টাব্দের ৪ মার্চ গান্ধি ও লর্ড আরউইনের মধ্যে | কিছু শর্ত সাপেক্ষে চুক্তি হয় ব্রিটিশ সরকার সত্যাগ্রহী বন্দিদের ছেড়ে দেবে। গান্ধি লন্ডনের দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠকে যোগ দেবেন। কিন্তু দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠকে গান্ধি লন্ডন থেকে হতাশ হয়ে ফিরলে আবার শুরু হয় আইন অমান্য আন্দোলন।
ব্রিটিশ সরকার দমনপীড়নের মাধ্যমেই আইন অমান্য আন্দোলনকে প্রতিহত করার চেষ্টা করে। রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে কংগ্রেসকে নিষিদ্ধ করে। জাতীয়তাবাদী সংবাদপত্রগুলিকে কঠোর বিধিনিষেধে বেঁধে দিয়ে ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার এক বৈঠক ডাকে। কংগ্রেস ওই বৈঠক বয়কট করলে দ্বিতীয়বার বৈঠক ডেকে সরকার তাতে গান্ধিকে যোগ দিতে রাজি করায়। লর্ড আরউইনের সঙ্গে গান্ধির একটি চুক্তি হয়। কিন্তু সেই চুক্তি লঙ্ঘিত হওয়ার ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে আবার গান্ধির আইন অমান্য আন্দোলনে যোগ দিয়ে লক্ষাধিক মানুষ কারাবরণ করে। ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে মে মাসে নিঃশর্তভাবে আইন অমান্য আন্দোলন তুলে নেওয়া হয়। রাজনৈতিক দল হিসেবে কংগ্রেস ধীরে ধীরে সাংবিধানিক অধিকার পাওয়ার লড়াইয়ে বেশি উৎসাহী হয়ে উঠেছিল। সেদিক থেকে গান্ধির স্বরাজের আদর্শ থেকে জাতীয় কংগ্রেস আস্তে আস্তে সরে যাচ্ছিল।
* ১৯৩০-এর দশকে কয়েকটি বিপ্লবী অভ্যুত্থান মাস্টারদা সূর্য সেন ও জালালাবাদের যুদ্ধ ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ১৮ এপ্রিল সূর্য সেনের নেতৃত্বে বিপ্লবীরা চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন করে জালালাবাদে পাহাড়ে আশ্রয় নেয়। সেখানে ব্রিটিশ সেনার সঙ্গে তিন দিনের লড়াইয়ে তাদের ১৯ জন বিপ্লবী নিহত হন। পুলিশ ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে সূর্য সেনকে ধরে ফেলে। বিচারে তাঁর ফাঁসি হয় ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দের ১২ জানুয়ারি।
বিনয়-বাদল-দীনেশ ও অলিন্দ অভিযান : ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ৮ ডিসেম্বর শূর ও নিকৃষ্ণ সেনের সহযোগিতায় বিনয় বসু, বাদল গুপ্ত ও দানেশ গুপ্ত হিটার্স বিল্ডিং-এর অলিন্দে ঢুকে পড়ে কারাবিভাগের ইন্সপেটর জেনারেল সিম্পসনসহ আরও দু-জনকে হত্যা করেন। পুলিশবাহিনীর সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ গুলি বিনিময়ের | পড়ার আগে বাদল বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেন। ক-দিন পরে আহত বিনয়ের মৃত্যু হয়। দীনেশ সুস্থ হয়ে ওঠার পর তাঁকে ফাঁসি দেওয়া হয়।
* ভগৎ সিং :
পদ্মাবে চন্দ্রশেখর আজান-এর অনুগামী ভগৎ সিং নওজোয়ান ভারতসভা সংগঠন গড়ে তোলেন। কাকোরি স্টেশনে রেল ডাকাতির অভিযোগে ১৯.20 খ্রিস্টাব্দে ভগৎ সিং ও তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে কাকোরি ষড়যন্ত্র মামলা করে। এই | মামলায় তাঁর সহযোগী রামপ্রসাদ বিশ্বমিল ও আসফাকউল্লাসহ চারজনের ফাঁসি হয়। এর | প্রতিবাদে ভগৎ সিং লাহোরের পুলিশ সুপার স্যান্ডার্সকে হত্যা করেন। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের ৮ এপ্রিল কেন্দ্রীয় আইনসভা কক্ষে ভগৎ সিং ও বটুকেশ্বর দত্ত বোমা ফেলেন ও স্বেচ্ছায় ধরা দেন। ব্রিটিশ প্রশাসন তাদের বিরুদ্ধে ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে লাহোর ষড়যন্ত্র মামল করে। ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে ভগৎ সিং, বটুকেশ্বর দত্ত, সুখনেও এবং রাজগুরুর ফাঁসি হয়। “ইনকিলাব জিন্দাবাদ' (বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক) বলেছিলেন ভগৎ সিং।
১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে 'ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ডাক নিয়ে গান্ধি নিজেই 'করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গে' ধ্বনি তুললে অহিংস সত্যাগ্রহের আদর্শ বিঘ্নিত হয়। ভারত জুড়ে সর্বশ্রেণির জনগণ ওই আন্দোলনে যোগ দিলে ওই বছর ৯ আগস্ট ব্রিটিশ সরকার গান্ধিসহ আন্দোলনের প্রধান নেতাদের কারারুদ্ধ করে। ভারত ছাড়ো আন্দোলনে শহর ও গ্রামের মানুষ যোগ দিলে পুলিশ ও সেনাবাহিনী জনগণকে প্রতিরোধের চেষ্টা করে। কিন্তু ক্ষিপ্ত জনগণ পুলিশ ও সেনাবাহিনীর ভয়ংকর প্রতিরোধ অগ্রাহ্য করেই বিভিন্ন অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা পর্যন্ত অচল করে দেয়। আন্দোলনকারীরা কয়েকটি অঞ্চলে 'জাতীয় সরকার গঠন করে।
+ ভাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার
মেদিনীপুরের তমলুক মহকুমার সতীশচন্দ্র সামস্তের নেতৃত্বে তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার গড়ে ওঠে। ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ৮ সেপ্টেম্বর জনৈক মিলমালিক বা শস্য পাচার করতে গেলে গ্রামবাসীদের সঙ্গে সংঘাত বাধে। তারপর থেকে তমলুক, মহিবাদল, নন্দীগ্রাম, ভগবানপুর প্রভৃতি অঞ্চলে যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিন্ন করে দেওয়া হয়। ২১ সেপ্টেম্বর অনেক মানুষদের সঙ্গে মিছিলে যোগ দিয়ে ৭২ বছরের বৃদ্ধা মাতঙ্গিনী হাজরা থানার বিক্ষোভ দেখাতে গেলে মুখোমুখি পুলিশের খুলিতে মারা যান। এরপর ঘূর্ণিঝড়ে মেদিনীপুরের কৃষি ব্যবস্থা বিধ্বস্ত হয়ে গেলে | ব্রিটিশ সরকারের তরফে ত্রাণ অত্যন্ত সামান্যই পাঠানো হয়। ফলে তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকারের উদ্যোগে বনী ব্যক্তিদের বাড়তি ধান গরিব ও দুর্গতদের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়া। হয়। তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার টিকে ছিল ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত।
ভারত ছাড়ো আন্দোলনের প্রধান শক্তি ছিল ব্যাপক সংখ্যায় শ্রমিকসহ ছাত্রছাত্রী ও কৃষিজীবী মানুষ। ওই আন্দোলন এতই ভয়ংকর ছিল যে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের পর এত বড়ো ঘটনা আর দেখা যায়নি। কঠোর হাতে ঔপনিবেশিক শাসকরা ওই আন্দোলন দমন করতে পারলেও তারা বুঝে গিয়েছিল যে ভারতবর্ষ আর তাদের শাসনাধীন থাকবে না।
+ ভারতের রাজনীতি ও অর্থনীতির ওপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব
বিশ্বযুদ্ধে পৃথিবীর বৃহত্তম শক্তিগুলি সকলেই জড়িয়ে পড়েছিল। ভাইসরয় লর্ড | লিনলিথগো ভারতকে একতরফা ‘যুদ্ধরত দেশ” বলে ঘোষণা করেন। ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে জাপান জোরকদমে যুদ্ধে যোগ দিলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ভারতের জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা প্রবল হয়। ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকা এবং রাশিয়াও ভারতীয়দের দাবির ব্যাপারে সহানুভূতি দেখায়। তার ফলে সার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপসের নেতৃত্বের একটি দল ভারতে এসে প্রতিশ্রুতি দেন যে যুদ্ধের পরে ভারতকে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার দেওয়া হবে। এদিকে যুদ্ধের ফলে খাদ্যসংকট ও মুদ্রাস্ফীতি চরম আকার ধারণ করে। তখন আবার গান্ধি 'ভারত ছাড়ো' ডাক দিয়েছেন। এমন সময় সুভাষচন্দ্র বসু সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে, বিশ্বযুদ্ধের পরিস্থিতিকে ভারতে ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধে কাজে লাগাতে হবে।
সুভাষচন্দ্র বসু ও আজাদ হিন্দ ফৌজের সংগ্রাম :
সুভাষচন্দ্র যখন রাজনীতিতে যোগ দেন তখন ভারতের সাধারণ জনগণ গান্ধির নেতৃত্বে বিভিন্ন আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল। সুভাষচন্দ্র ছিলেন সর্বদাই পূর্ণ স্বরাজের দাবিদার। তিনি ছিলেন বিংশ শতকের জর্মান জাতীয়তাবাদী ভাবধারার শরিক, আবার সোভিয়েত রাশিয়ার অর্থনৈতিক আদর্শের কিছুটা অনুগামী। তাকে কিছুটা আবার স্বামী বিবেকানন্দের সাংগঠনিক ভাবনাচিন্তাও অনুপ্রাণিত করেছিল। সুভাষচন্দ্র গান্ধির অহিংসার আদর্শে পুরোপুরি একমত না হলেও গান্ধির নেতৃত্ব স্বীকার করে নেন। কিন্তু বিশের দশকে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের সঙ্গে তাঁর কিছু চিঠিপত্র বিনিময়ের পর চিত্তরঞ্জনের নেতৃত্বে বাংলার রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেন। অবশ্য অসহযোগ আন্দোলনে তিনি কারাবরণ করতে বাধ্য হন।
সুভাষচন্দ্র ছিলেন চিত্তরঞ্জন ও মোতিলাল নেহরুর স্বরাজ্য দলের সচিব। স্বরাজ্য দলের
তরফে তিনি ফরোয়ার্ড ব্লক পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব নেন। ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে স্বরাজ্য দলের হয়ে জয়লাভ করে চিত্তরঞ্জন কলকাতা কর্পোশেনের মেয়র হন এবং সুভাষচন্দ্ৰ প্রধান কার্যনির্বাহকের দায়িত্ব পান। ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে চিত্তরগুনের মৃত্যু হলে সুভাষচন্দ্র নিজের উদ্যোগেই পূর্ণ স্বরাজের পক্ষে বক্তব্য প্রচার করেন। ব্রিটিশ সরকারের প্রস্তাবিত যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থাকে তিনি নাকচ করে দিলে এই প্রসঙ্গে ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা অধিবেশনে গান্ধির সঙ্গে তাঁর সংঘাত শুরু হয়।
* সুভাষচন্দ্রের ছাত্রজীবন :
প্রেসিডেন্সি কলেজে ইংরেজি অধ্যাপক ই, এফ. ওটেনকে ঘিরে ছাত্র-বিক্ষোভে জড়িয়ে পড়েন সুভাষচন্দ্র। ফলে কয়েকজন সহপাঠীসহ (তাঁকে কলেজ থেকে বহিষ্কৃত হতে হয়। এরপর তিনি স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে বি.এ
পাশ করেন। ছাত্র থাকাকালীন কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে টেরিটোরিয়াল আর্মির শাখায় | চার মাসের জন্য যোগদান করে সুভাষচন্দ্র সামরিক প্রশিক্ষণ ও অসামরিক জীবন | সম্পর্কে কিছু ধারণা অর্জন করেন। ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভরতি হওয়ার পাশাপাশি সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার প্রস্তুতিও নিতে শুরু করেন। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে সুভাষচন্দ্র আই.সি.এস পরীক্ষায় চতুর্থ স্থান অর্জন করেন।
১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে আইন অমান্য শুরু হওয়ায় সুভাষচন্দ্র আবার কারাবরণ করতে বাধ্য হন। কিন্তু অসুস্থ হয়ে পড়ার ফলে তাঁকে ইউরোপে নিয়ে যাওয়া হয়। ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে ইটালির রাষ্ট্রপ্রধান বেনিতো মুসোলিনির সঙ্গে সুভাষের পরিচয়ক্রমে মুসোলিনির দুর্নীতি দূরীকরণ ও সামাজিক সেবা প্রকল্পগুলি তাঁকে উৎসাহিত করে। ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে আইন অমান্য আন্দোলন তুলে নেওয়া হলে তিনি কংগ্রেসের তীব্র সমালোচনা করেন। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে সুভাষচন্দ্র, জওহরলাল প্রমুখ তরুণ নেতা স্বাধীনতা সংগ্রামে ও ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রগঠনে যুব সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে বৈপ্লবিক কর্মসূচির দাবি তোলেন। এই নিয়ে কংগ্রেসের মধ্যে বিরাট ফাটল দেখা দেয়। সাধারণ মানুষ কংগ্রেস সম্পর্কে হতাশ হয়ে পড়লে কগ্রেসের সদস্য সংখ্যা ক্রমেই কমতে শুরু করে। চূড়ান্ত অসন্তোষ দেশজোড়া গণঅভ্যুত্থানের পথ তৈরি করেছিল। সেই গণঅভ্যুত্থানের উদাহরণ হল ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ভারত ছাড়ো আন্দোলন।
+ কংগ্রেসের হরিপুরা ও ত্রিপুরি অধিবেশন :
১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে হরিপুরা কংগ্রেসে | গান্ধি-মনোনীত পট্টভি সীতারামাইয়াকে হারিয়ে সুভাষচন্দ্র সভাপতির পদে নির্বাচিত হন। গান্ধি ও তাঁর অনুগামীদের সঙ্গে তরুণ নেতৃত্বের তিক্ততা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছোলে পরের বছর ত্রিপুরি কংগ্রেসে সুভাষচন্দ্র সভাপতির পদ ত্যাগ করে দলের মধ্যেই সহকর্মীদের নিয়ে গঠন করেন ফরোয়ার্ড ব্লক। পারস্পরিক মতবিরোধ চূড়ান্ত পর্যায়ে। গেলে সুভাষচন্দ্র ও শরচন্দ্র বসুকে কংগ্রেস থেকে সাসপেন্ড করা হয়। কংগ্রেসের কোনো নির্বাচিত পদে লড়াই করার ব্যাপারে তাঁকে ৬ বছরের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়। + হলওয়েল মনুমেন্ট সরানোর আন্দোলন : ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে সুভাষচন্দ্র ভারতব্যাপী আন্দোলন সংগঠিত করার মনস্থ করলে জনসংযোগের ব্যাপারে খুব ইতিবাচক সাড়া পাননি। অনেকেই মনে করতেন, হলওয়েল-বর্ণিত সিরাজকৃত নৃশংস অন্ধকূপ হত্যা বোধহয় সত্যই ছিল। ফলে হলওয়েল মনুমেন্টটিও সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শাসনের প্রতীক হয়ে উঠেছিল। এই মিথ্যার বিরুদ্ধে সুভাষচন্দ্র বাংলায় ফিরে এসে হলওয়েল মনুমেন্ট সরানোর আন্দোলন গড়ে তোলেন। হলওয়েল মনুমেন্ট সরানোর আন্দোলনে বাংলার হিন্দু ও মুসলমান মানুষজন একজোট হন। তবে, ওই আন্দোলন বাস্তবায়িত হওয়ার আগেই সুভাষকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে অবশ্য ভেঙে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল ওই হলওয়েল মনুমেন্ট।
ইতিমধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছে। ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে রামবহারী বসু জাপানে যুদ্ধবন্দি ব্রিটিশ-বাহিনীর ভারতীয় সৈন্যদের নিয়ে সিঙ্গাপুরে যে আজাদ হিন্দ বাহিনী গড়ে তুলেছিলেন, সুভাষচন্দ্র জাপানে গিয়ে সেই বাহিনীর সর্বাধিনায়কের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের ২২ অক্টোবর সুভাষচন্দ্র আজাদ হিন্দ বা স্বাধীন ভারতের যুদ্ধকালীন সরকার প্রতিষ্ঠা করে তিনিই প্রধানমন্ত্রী ও বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হন।
মোহম্মদ জিয়াউদ্দিনের অন্তর্ধান :
১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের ১৬ জানুয়ারি কলকাতার ৩৮/২ এলগিন রোডের বসুবাড়ি থেকে মধ্যরাতে গাড়ি করে যে দু-জন বেরিয়ে গেলেন তাদের একজন হলেন মাথায় কালো টুপি ও ঢিলে সালোয়ার পরা মোহম্মদ | জিয়াউদ্দিনের ছদ্মবেশে সুভাষচন্দ্র এবং অপরজন গাড়ির চালক হলেন সুভাষের ভাইপো শিশিরকুমার বসু। কিছুদিন ধরে নিজের বাড়িতে নজরবন্দী অবস্থায় ছিলেন। তিনি। গোমো স্টেশনে কালকা মেলে চেপে তিনি পেশোয়ার, কাবুল হয়ে আবার ইটালি ও মস্কো মুলে জার্মানির রাজধানী বার্লিনে গিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উত্তাল পরিস্থিতিতে হিটলারের সাহায্য প্রার্থনা করলেন। কিন্তু নিরাশ হলেন।
→ আজাদ হিন্দ ফৌজের প্রতি সুভাষচন্দ্র বসুর আহ্বান :
পাঠ্যাংশে উদ্ধৃত সুভাষের বক্তব্যটি নেওয়া হয়েছে ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের ২৫ আগস্ট 'আজাদ হিন্দ ফৌজের সর্বাধিনায়ক হিসেবে নির্দেশনামা' থেকে। এখানে গৃহীত তাঁর এই বক্তব্যের সারকথা হল-
আমি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন এবং আজাদ হিন্দ ফৌজের স্বার্থে আজ থেকে আমাদের সেনাবাহিনীর সরাসরি কর্তৃত্ব গ্রহণ করলাম। ভারতীয় হয়ে ভারতের মুক্তিফৌজের সেনাপতি হওয়া সর্বাপেক্ষা বড়ো সম্মান। ভারতের আটত্রিশ কোটি জনগণের স্বার্থ যাতে আমার হাতে নিরাপদ থাকে তার প্রাণপণ চেষ্টা আমি করব। প্রকৃত জাতীয়তাবাদ, ন্যায়বিচার এবং নিরপেক্ষতার নীতি অবলম্বন করব। ভারতের স্বাধীনতা চিরদিন রক্ষার জন্য আজাদ হিন্দ ফৌজকে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। সেনাবাহিনীর লক্ষ্য একটাই— হয় ভারতের স্বাধীনতার জন্য লড়াই, নয় মৃত্যুবরণ।
সহকর্মী, অফিসার এবং সৈন্যগণ আপনাদের আকুণ্ঠ সহায়তা এবং অটল আনুগত্যের ফলে আজাদ হিন্দ ফৌজ ভারতের মুক্তি আনতে পারবেই এই আশ্বাস আমি আপনাদের দিতে চাই। আমাদের কাজ ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে। আসুন, 'দিল্লি চলো' ধ্বনি দিতে দিতে আমরা যতদিন না নয়াদিল্লির ভাইসরয়ের প্রাসাদের চূড়ায় জাতীয় পতাকা উড্ডীন না হয় এবং লালমোর ভিতরে আজাইহিন্দ ফৌজের বিজয়সূচক বুচকাওয়াজ না করে ততদিন আমাদের সংগ্রাম চলবে।
+ রানি ঝাঁসি বাহিনী
কংগ্রেসে থাকাকালীনই সুভাষচন্দ্র সামরিক কাজে নারীদের অংশগ্রহণ নিয়ে ভাবনাচিন্তা করেছিলেন। তাই তিনি ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের | অন্যতম নেতৃত্ব রানি লক্ষ্মীবাইয়ের নামে আজাদ হিন্দ ফৌজের নারীবাহিনীর নাম রাখেন। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন অংশ থেকে প্রায় ১৫০০ নারী ওই বাহিনীতে যোগ, দিয়ে ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে মণিপুরে ইম্ফল অভিযানে সরাসরি যুদ্ধে নেমেছিল।
নভেম্বর মাসে জাপানের প্রধানমন্ত্রী তোজো আজাদ হিন্দ সরকারের হাতে জাপান অধিকৃত আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ তুলে দেন। ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দের ৪ ফেব্রুয়ারি আজাদ হিন্দ বাহিনীর প্রথম ব্যাটেলিয়ন ভারত অভিমুখে এগিয়ে চলে। ১৯ মার্চ আজাদ হিন্দ বাহিনী ভারতের মাটিতে পতাকা উত্তোলন করে এবং এপ্রিল মাসে কোহিমা অবরোধ করে। ইতিমধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান কোণঠাসা হয়ে পড়লে আজাদ হিন্দ বাহিনীর দুই রেজিস্টারসহ জাপানের সেনাবাহিনীর ইম্ফল অভিযান বিপর্যন্ত হয়। নানাবিধ প্রাকৃতিক বাধার কারণে আজাদ হিন্দ বাহিনীর অসংখ্য সৈন্য মারা যায়। তবুও আশাবাদী সুভাষচন্দ্রকে জাপান সরকার রাশিয়ায় চলে যাওয়ার জন্য মাঞ্চুরিয়া পর্যন্ত ব্যবস্থা করে দেয়। কিন্তু যাত্রাপথে তাইওয়ানে ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ১৮ আগস্ট ভাইহোক বিমানবন্দরে এক বিমান দুর্ঘটনায় সুভাষচন্দ্রের মৃত্যু হয় বলে জানা যায়। তবে ওই খবরের সভ্যতা আজও ভারতবাসীর মনে সংশয় সৃষ্টি করে রেখেছে।
আজাদ হিন্দ ফৌজের বহু সেনা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। দিল্লির লালকেল্লায় তাঁদের বিচার হয়। তাঁদের মধ্যে পি. কে সেহগাল, জি. এস. ধিলো ও শাহনওয়াজ খান ব্রিটিশ সরকারের চোখে দেশদ্রোহিতার জন্য অভিযুক্ত হন। আজাদ হিন্দ বাহিনীর লড়াইয়ের প্রভাব ভারতীয় সেনাদের ওপর পড়েছিল। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে ব্রিটিশ সরকারের নৌবাহিনী প্রকাশ্যে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। ব্রিটিশ সরকার বুঝতে পারে ভারতের মাটি থেকে তাদের এবার বিদায় নেওয়ার সময় এসে গেছে।
+ আজাদ হিন্দ বাহিনীর বিচার ও গণবিক্ষোভ :
আজাদ হিন্দ বাহিনীর বিচার চলাকালীন ভারতীয় জনমানসে তীব্র বিক্ষোভের সৃষ্টি হয়। দেশের বিভিন্ন জায়গার আজাদ বাহিনীর দেশপ্রেমিকদের বিনা শর্তে মুক্তির জন্য মিছিল-মিটিং চলে। সুভাষচন্দ্র তাঁর ফৌজের মধ্যে হিন্দু-মুসলমান-নিখকে একসঙ্গে রেখেছিলেন। ব্রিটিশরাজ কর্তৃক আজাদ হিন্দ ফৌজের বিচারের বিরুদ্ধে সমস্ত সম্প্রদায়ের ভারতবাসী বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে ফেব্রুয়ারি মাসে বিচারাধীন আবেদ হিন্দ ফৌজের বন্দিদের শান্তি ঘোষিত হলেও গণ অভ্যুত্থানের আশসায় ব্রিটিশ সরকার তাদের মুক্তি দেয়।
+ নৌ-বিদ্রোহ :
১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ১৮ থেকে ২৩ ফেব্রুয়ারি খাবারের খারাপ মান ও বর্ণবৈষম্যের অপমানের বিরুদ্ধে এবং আজাদ হিন্দ বাহিনী ও অন্যান্য রাজবন্দিদের মুক্তির দাবিতে 'তলোয়ার জাহাজের সেনারা সমস্ত রাজনৈতিক দলের পতাকা জাহাজের মাস্তুলগুলিতে উড়িয়ে দেন ও ধর্মঘট করেন। ব্রিটিশ প্রশাসন চূড়ান্ত দমননীতিতে তা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করলে তা দ্রুতই সংঘর্ষের চেহারা নেয়। নৌ-বিদ্রোহীদের সমর্থনে ভারতের নানা জায়গায় ছাত্র-যুব ও সাধারণ মানুষ পথে নামলেও মহাত্মা গান্ধি সহ কংগ্রেস ও মুসলিম লিগ নৌ-বিদ্রোহীদের সমর্থন করেননি।
---------------------------------------------------------