অষ্টম শ্রেণীর ইতিহাস
| অষ্টম অধ্যায় |
| সাম্প্রদায়িকতা থেকে দেশভাগ |
class 8 history lesson 8
১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহে হিন্দু ও মুসলমানের অটুট ঐক্য ছিল। সুলতানি ও মুঘল আমলেও হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে ছিল সুগভীর আন্তরিক সম্প্রীতি। কিন্তু ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৪ আগস্টের পর কী এমন ঘটনা ঘটল যে হিন্দুস্থানের পঞ্জাব প্রদেশের ওপর দিয়ে চলে গেল ভারতভাগের সীমারেখা? বাংলাও দেশভাগের যন্ত্রণাদীর্ণ হয়ে থাকল?
• ঔপনিবেশিক ভারতে সাম্প্রদায়িক পরিচয়ের বিকাশ :
ভারতীয় উপমহাদেশে একসময় অঞ্চলভেদে মুসলমানদের মধ্যে অর্থনৈতিক ও জীবনযাপনের তারতম্য ছিল। অঞ্চলভেদে ছিল মুসলমান জনসংখ্যার বৈষম্য। কিন্তু ঔপনিবেশিক সরকার অঞ্চলভেদে মুসলমানদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের বদলে ভারতের সমস্ত মুসলমানকেই একটি ধর্মসম্প্রদায় বলে চিহ্নিত করে। ফলে ব্রিটিশ শাসকদের মতো করে মুসলমানদের একটি অংশ হিন্দুদের থেকে নিজেদের একটি আলাদা সংগঠিত সম্প্রদায় ভাবতে শুরু করে। ঔপনিবেশিক সরকার ভারতের এক-একটি সামাজিক অংশের জন্য এক-একরকম প্রশাসনিক পদক্ষেপ নিত। ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে ঔপনিবেশিক সরকার ধর্মের ভিত্তিতে সমাজে সাম্প্রদায়িক বিভেদকে উৎসাহ দিয়ে ভারতীয়দের ধারণাকে আঘাত করতে চেয়েছিল।
ব্রিটিশ প্রশাসন আপাতভাবে ভারতে ধর্মনিরপেক্ষ শাসনব্যবস্থা চালু করলেও হিন্দু সম্প্রদায় ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে সুযোগ-সুবিধা ভাগাভাগির প্রশ্নে ঔপনিবেশিক প্রশাসনের তরফে বিভাজন নীতি প্রকট হয়। ১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দে সরকারি ভাষা হিসেবে ফারসির বদলে ইংরেজিকে স্বীকৃতি দেওয়ায় অতি সীমিত ইংরেজি জানা মুসলমান সম্প্রদায় সরকারি চাকরি ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে ক্রমাগত পিছিয়ে পড়তে থাকে। ঔপনিবেশিক শাসকদের ভুলে বিশেষ করে বাংলার মতো অঞ্চলের বিরাট সংখ্যক গরিব ও নিরক্ষর মুসলমান সম্প্রদায় যাবতীয় সরকারি সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে পড়ে। ফলে সম্প্রদায় হিসেবে মুসলমান ও হিন্দুদের অবস্থান পরস্পরবিরোধী—এই ধারণা পাকাপোক্ত হয়ে ওঠে।
আদমশুমারি ও সম্প্রদায় ধারণা : ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দের জনগণনায় জানা যায়। ভারতবর্ষের পঞ্জাব ও বাংলার জনসংখ্যার অর্ধেকই মুসলমান। ওই আদমশুমারিতে ঔপনিবেশিক সরকার ব্যক্তির ধর্মীয় ও জাতিগত পরিচয়কে প্রধান বলে ধরে নেওয়ার জন্য ধর্মের ভিত্তিতে প্রতিটি সম্প্রদায়ের উন্নয়নের খতিয়ান রাখা হত আদমশুমারিতে। এর পরিণতিস্বরূপ ভারতীয় উপমহাদেশে ধর্মসম্প্রদায়গুলির মধ্যে সুযোগসুবিধা পাওয়া নিয়ে প্রতিযোগিতা ও সংঘর্ষ শুরু হয়। সেই সংঘর্ষ একসময় ভারতীয় সমাজ ও রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িক সমস্যার জন্ম দেয়।
স্যর সৈয়দ আহমদ খান ইসলামীয় ধর্মতত্ত্বের সঙ্গে পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞানের সম্মিলন ঘটিয়ে ভারতীয় মুসলমানদেরকেও শিক্ষিত করে তুলে হিন্দুদের মতো স্বনির্ভর করে তুলতে চেয়েছিলেন। তিনি ইউরোপীয় দর্শনের সঙ্গে ইসলামীয় ধর্মতত্ত্বের সহাবস্থান দেখিয়ে বৃহত্তর মুসলিম সমাজকে শিক্ষিত করে তোলার জন্য আলিগড়ে মহামেডান অ্যাংলো ওরিয়েন্টাল কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। জাতীয় কংগ্রেস সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের প্রতিনিধি-সভা মনে করে সার সৈয়দ আহমদ জাতীয় কংগ্রেসে মুসলমানদের যোগ না দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। যদিও অন্যান্য মুসলিম নেতা যেমন বদরুদ্দিন তৈয়াবজি কংগ্রেসেই যোগ দিয়েছিলেন। সৈয়দ আহমদের পাশ্চাত্যকরণ বিষয়টিকে উলেমারা পছন্দ করেননি। জামালউদ্দিন আল আফগানির মতো গোঁড়া উপনিবেশবিরোধী মুসলমানরা ইসলামীয় সর্বজনীনতা ও স্বাতন্ত্রের কথা বলেছিলেন।
১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে স্যর সৈয়দ আহমদের মৃত্যু হলে মুসলমান-রাজনীতির ভরকেন্দ্ররূপে আলিগড় গুরুত্ব হারাতে থাকে। ফলে বিংশ শতকের শুরুতে মোহম্মদ আলি ও সৌকত আলির মতো তরুণ প্রজন্মের নেতারা উলেমা দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হন। তখন সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে হিন্দুদের থেকে মুসলমানরা অপেক্ষাকৃত পিছিয়ে আছে এই যুক্তিতে হিন্দু ও ব্রিটিশ সরকার উভয়েরই বিরুদ্ধে নতুন রাজনৈতিক সংগঠন তৈরি করা আশু প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।
* মুসলিম লিগ :
১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের বলাভঙ্গের ঘোষণার পরে ব্রিটিশ সরকার মুসলমান সম্প্রদায়ের শিক্ষিত শ্রেণির কাছে সুযোগের সম্ভাবনা তুলে ধরলে বাংলা ও উত্তর ভারতের শিক্ষিত মানুষেরা একজোট হন। ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে তাঁরা ঢাকায় মহামেডান এডুকেশন ফোরামের অধিবেশনে মুসলমানদের জন্য আলাদা। রাজনৈতিক দল হিসেবে অল ইন্ডিয়া মুসলিম লিগ গড়ে তোলেন। ১৯১০ খ্রিস্টাব্দের পর মহামেডান এডুকেশন ফোরাম থেকে সরে গিয়ে ভাল ইন্ডিয়া মুসলিম লিগ ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে তাঁর আদর্শ প্রচার করতে থাকেন।
অন্যদিকে, মুসলমানদের সম্পর্কে বাংলায় হিন্দু ভদ্রলোক সম্প্রদায়ের অনেকেই নেতিবাচক ও তাচ্ছিল্যের মনোভাব ব্যক্ত করতেন। তা ছাড়া স্বদেশি নেতৃত্ব তাঁদের হিন্দুধর্মীয় প্রতীক-কেন্দ্রিক রাজনীতির মাধ্যমে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে সামাজিক বিভাজন আরও প্রকট করে তোলেন। তাঁদের কাছে আবার বাঙালি পরিচয়ের বদলে হিন্দু ও মুসলমান পরিচয় বড়ো হয়ে ওঠে। জাতীয় কংগ্রেসের প্রাথমিক পর্বে মুসলমান স্বার্থবিরোধী কোনো প্রস্তাব নেওয়া হবে না বলা হলেও বক্তৃতামঞ্চে আলোচিত হতে থাকে যে, মুসলমান শাসনের কারণেই হিন্দু সভ্যতার গৌরবময় অতীত নষ্ট হয়েছে। অধিকাংশ বিজ্ঞানী জাতীয়তাবাদী ভারতীয় সংস্কৃতি ও ভারতীয় জাতিকে হিন্দুধর্ম এবং হিন্দুদের বলে চিহ্নিত করতে থাকেন। অবশ্য অনেক হিন্দু স্বাধীনতা সংগ্রামী বলেছিলেন, হিন্দু ও মুসলমান দুটি সম্প্রদায়ের মিলনেই দেশের অনগ্রসরতা দূর করা যাবে।
অন্যদিকে অনেক শিক্ষিত মুসলমান জাতীয় আন্দোলনে হিন্দু ধর্মীয় ঝোকে দেখে নিজেদের সম্প্রদায়গত অস্তিত্ব বজায় রাখার চেষ্টায় রক্ষণশীল রাজনীতির শিকার হয়ে পড়েন। তার ফলে উচ্চাকাঙ্ক্ষী রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও উলেমার ঘনিষ্ঠ সহযোগিতায় মুসলমানদের নতুন সংগঠন তৈরি হয়। দ্বিজাতি তত্ত্বের ধারণা দৃঢ় হয়। হিন্দু-মুসলমান পারস্পরিক বোঝাপড়া ও সহমর্মিতার বদলে বিরোধিতার ভিত্তি পাকাপোপ্ত হতে থাকে। • সাম্প্রদায়িক পাটোয়ারার পথে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুরস্ক ব্রিটেনের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করে। তুরস্কের সুলতানকে 'খলিফা' বা মুসলিম জগতের ধর্মগুরু মনে করা হত। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষে তুরস্কের পরাজয়োর পরে ব্রিটিশরা তুর্কি অটোমান সাম্রাজ্যের অনেকটাই দখল করে নেয়। ফলে ভারতীয় মুসলমানরা তাদের পবিত্র স্থানগুলি খলিফাকে ফেরত দেওয়ার দাবিতে ভারতের ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনকে জোরদার করে। ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বরে মুসলিম লিগ ও কংগ্রেসের নেতারা দিল্লিতে এক বৈঠকে মিলিত হয়ে খলিফা সংক্রান্ত দাবিতে তীব্র সোচ্চার হয়। ইতিমধ্যে গান্ধিজি কংগ্রেসের এবং মোহম্মদ আলি জিন্নাহ, ওয়াহাজিব হাসান প্রমুখ আসেন লিগের নেতৃত্বে। ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে খিলাফৎ আন্দোলনের সমর্থনে গান্ধিজি পথে নেমে পড়েন। তিনি কংগ্রেসের ভিত্তি প্রসারিত করার জন্য খিলাফৎ সমস্যাকে অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের অন্যতম দাবি রূপে অন্তর্ভুক্ত করেন।
কিন্তু ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে অসহযোগ আন্দোলন তুলে নেওয়া হলে খিলাফৎ আন্দোলনও স্তিমিত হয়ে যায়। ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে তুরস্কের খলিফা পদের অবসান ঘটলে খিলাফৎ আন্দোলন গতি হারিয়ে ফেলে। কিন্তু খিলাফৎ আন্দোলনে উলেমাদের উপস্থিতি ও ধর্মীয় প্রতীকের ব্যবহারে যে ধর্মীয় ভাবাবেগ সৃষ্টি হয়েছিল তা একসময় মুসলিম লিগের কর্মসূচিতে ছাপ ফেলে। এদিকে মদনমোহন মালব্য প্রমুখ নেতাদের গোঁড়া হিন্দুত্ববাদী কার্যকলাপ কংগ্রেসে প্রাধান্য লাভ করলে মুসলমান সম্প্রদায় ক্রমশ কংগ্রেসের সঙ্গে দূরত্ব রচনা করে। অন্যদিকে মুসলমানদের মধ্যেও মোহম্মদ আলির মতো সাম্প্রদায়িক ঐক্যের সমর্থক নেতারাও হয়ে পড়েন কোণঠাসা।
উগ্র হিন্দু নেতাদের চাপে মোতিলাল নেহরুর মতো স্বরাজ্যপন্থী নেতারা হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের উদ্যোগ নিতে ব্যর্থ হন। মোহম্মদ আলি জিন্নাহও স্বরাজ্যপন্থীদের সঙ্গে বোঝাপড়ায় উৎসাহী থাকলেও ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে বাংলা ও পদ্মাবে কংগ্রেসের মধ্যে কোনো মুসলমান প্রার্থী ছিল না। ফলে শওকত আলির মতো সম্প্রীতিবাদী নেতারাও কংগ্রেসের মধ্যে উগ্র হিন্দু মতামতের বাড়বাড়ন্তে হতাশ হয়ে পড়েন। ফলে আইনঅমান্য আন্দোলনে মুসলমানদের অংশগ্রহণ ছিল অত্যন্ত সীমিত। জাতীয় আন্দোলন থেকে সরে থাকার এই প্রবণতাকেই সাম্প্রদায়িকতা বলে ইতিহাসগতভাবে ভুল ব্যাখ্যা করা হয়। ১৯৩০-এর দশক দ্বি-জাতি তত্ত্বের গুরুত্বপূর্ণ সময়। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে মুসলিম লিগের সভাপতি মোহম্মদ ইকবাল এবং চৌধুরি রহমৎ আলি পরাব, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত
প্রদেশ, বালুচিস্তান ও কাশ্মীর নিয়ে মুসলমানদের আলাদা ভূখণ্ড গঠন করার প্রস্তাব দেন।
১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী র্যামসে ম্যাকডোনাল্ড-এর ঘোষণায় সাম্প্রদায়িক
বাঁটোয়ারার কথা বলা হয়। এরপর থেকেই ভারতের সাধারণ মানুষের স্বার্থের পরিবর্তে
ভিন্ন গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের স্বার্থই বড়ো হয়ে দেখা দিয়েছিল।
ভারত বিভাজনের সিদ্ধান্ত : ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের ভারতশাসন আইন অনুসারে ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে প্রাদেশিক বিধানমণ্ডলীর জন্য নির্বাচনে কংগ্রেস সাফল্য পেলেও মুসলিম লিগ ফল ভালো করতে পারেনি। ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে মুসলিম লিগের লাহোর অধিবেশনে মুসলমানদের আলাদা জাতি হিসেবে ঘোষণা করা হয়। জিন্নাহও সেই বছরে প্রথম দ্বি-জাতি তত্ত্বের প্রসঙ্গ সমর্থন করে প্রবন্ধ লেখেন।
+ মোহম্মাদ ইকবাল :
আধুনিক ভারতের তরুণ কবি মোহম্মদ ইকবাল মুসলিম ছেলেমেয়েদের ধর্মীয় ও দার্শনিক ভাবনাকে তাঁর কবিতার মাধ্যমে গভীরভাবে আলোড়িত করেন। 'সারে যাঁহা সে আচ্ছা হিন্দুস্তাঁ হামারা' ইত্যাদি দেশাত্মবোধক জনপ্রিয় কবিতা তাঁরই রচনা। শেষের দিকে তিনি অবশ্য পৃথক মুসলিম রাষ্ট্রের পক্ষে সমর্থন করেছিলেন।
* পাকিস্তান প্রস্তাব ঃ
১৯৩৩-৩৪ খ্রিস্টাব্দে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র চৌধুরি রহমত আলি 'পাকিস্তান' নামক একটি রাষ্ট্রের কথা বলেছিলেন। ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দেও মোহম্মদ আলি জিন্নাহর সভাপতিত্বে মুসলিম লিগের লাহোর অধিবেশনে ফজলুল হকের প্রস্তাবে মুসলমানদের জন্য স্বশাসিত পৃথক একটি রাষ্ট্রের দাবি ওঠে। মুসলমানদের জন্য পৃথক স্বশাসিত রাষ্ট্রের এই প্রস্তাবই 'পাকিস্তান প্রস্তাব' নামে পরিচিত। যদিও লাহোর অধিবেশনে 'পাকিস্তান' নামের উল্লেখ ছিল না।
১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে তাঁর আগস্ট ঘোষণায় লর্ড লিনলিথগো প্রথম ঘোষণা করেন, ভারত-ব্রিটেন সমঝোতা হলে মুসলমানদের পূর্ণ নিরাপত্তার বন্দোবস্ত হবে। ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ৮ আগস্ট 'ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সূচনা হলেও মুসলিম লিগ আন্দোলনের বিরোধিতা করে। মুসলিম লিগের সমর্থনে মুসলমান-নিয়ন্ত্রিত অসংখ্য সংবাদপত্রে পাকিস্তান গঠনের দাবি ওঠে। ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে সিমলা অধিবেশনে লিগ নিজেকে সমস্ত ভারতীয় মুসলমানদের প্রতিনিধি হিসাবে দাবি করলে কংগ্রেস তার বিরোধিতা করে। ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে লিগ ও কংগ্রেসের মধ্যে সিমলার বৈঠকেও মোহম্মদ আলি জিন্নাহর ক্ষমতার অনড় পাবিতে মুসলিম জনগণ ব্যাপকভাবে সাড়া দিতে থাকে। এর সঙ্গে পির ও উলেমাও পাকিস্তান প্রস্তাবকে সমর্থন ও ধর্মীয় বৈধতা দান করে।
ভারতীয় উপমহাদেশের সমস্ত ধরনের মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব করত না মুসলিম লিগ। বাংলায় এ. কে. ফজলুল হক -এর কৃষক প্রজা পার্টি' নীচ জাতির হিন্দু ও মুসলমান উভয় কৃষকদের স্বার্থের দিকটিই বেশি করে উল্লেখ করত। পদ্মানেও ছিল স্যর সিকন্দর ইয়াৎ খান-এর ইউনিয়নিস্ট পার্টি। এই দুই পাটি শিক্ষিত মুসলমানদের প্রভাবিত কিংবা কিছু পেশাদার ও ব্যবসায়ী গোষ্ঠীদের সমর্থিত মুসলিম লিগকে বিশেষ একটা গুরুত্ব দিতে চায়নি। তথাপি ওই দুটি পার্টি দুর্বল হয়ে পড়লে পঞ্জাব ও বাংলায় মুসলিম লিগ প্রভাব বিস্তার করে। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের নির্বাচনে কংগ্রেসের সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভে মুসলিম লিগের মধ্যে আশঙ্কার জন্ম দেয়। লিগের দাবিতে বিচ্ছিন্নতার মাত্রা বাড়ে। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ১৬ আগস্ট থেকে পাকিস্তানের জন্য গণআন্দোলন হয়। ওই বছর কলকাতায় ভয়াবহ দাঙ্গা শুরু হয়। ওই দাঙ্গা শীঘ্রই পূর্ববঙ্গ, বিহার, যুক্তপ্রদেশ, পঞ্জাব প্রভৃতি জায়গাতেও ভয়ংকর আকার ধারণ করে।
১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে নেহরুর নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রশাসনে অবস্থান বজায় রাখতে লিগ যোগ দিতে সম্মত হয় এবং পাঁচজন প্রতিনিধি পাঠায়। এদিকে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে চলতে থাকা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সামাল দিতে ব্যর্থ হয় ব্রিটিশ সরকার। ভয়ংকর এই অবস্থা কাটিয়ে উঠতে কংগ্রেস ও মুসলিম লিগ ভারত বিভাজনকে একমাত্র উপায় মনে করে। ফলে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৪ এবং ১৫ আগস্ট পাকিস্তান ও ভারত নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র ভূমিষ্ঠ হয়।
র্যাডক্লিফ লাইন :
১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে অনেক টানাপোড়েনের পর লর্ড মাউন্টব্যাটেনের ভারত-বিভাগের পরিকল্পনা কংগ্রেস ও লিগ মেনে নেয়। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী বাংলা ও পদ্মাবকে ভাগ করার জন্য দুটি পৃথক সীমাও কমিশন পাঠন করা হয়। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ২৭ জুন বিশিষ্ট ব্রিটিশ আইনজীবী সার সিরিশ রাডক্লিফ ভারতের বিভাজন মানচিত্র তৈরি করেন। এই মানচিত্র তৈরি করতে গিয়ে বাংলা ও পঞ্চাবের সাধারণ মানুষের কোনো মতামত নেওয়া হয়নি। এমনকি অনেক এলাকা তিনি স্বচক্ষেও দেখেননি। ফলে ক্ষমতা হস্তান্তরের পাশাপাশি বীভৎস দাঙ্গা ও উপবাস্তু জীবন স্বাধীনতাকে করেছিল কালিমালিপ্ত।
আরো পড়ুন >>>
অষ্টম শ্রেণীর ইতিহাস প্রথম অধ্যায়
অষ্টম শ্রেণীর ইতিহাস দ্বিতীয় অধ্যায়
অষ্টম শ্রেণীর ইতিহাস তৃতীয় অধ্যায়
অষ্টম শ্রেণীর ইতিহাস চতুর্থ অধ্যায়
অষ্টম শ্রেণীর ইতিহাস পঞ্চম অধ্যায়