অষ্টম শ্রেণীর ইতিহাস
প্রথম অধ্যায়
ইতিহাসের ধারণা
History class 8 lesson 1
আমরা সকালে প্রায়ই বলাবলি করি, এ যুগ বিজ্ঞানের যুগ। প্রতিদিনের জীবনে আমরা প্রতিটি মুহূর্ত বিজ্ঞানের সাহায্য নিয়ে এগিয়ে চলেছি। সুতরাং প্রশ্নটা এসেই যায়। বিজ্ঞানের যুগে বাস করে আমরা ইতিহাস পড়ব কেন? ইতিহাস বলতে তো সেই পুরোনো দিনের কবে, কে, কী করেছে এসব নিয়েই আলোচনা। ইতিহাসের কথা মানে শুধু রাজা-সম্রাট যুদ্ধ ও রাজস্ব নীতির একঘেয়ে কথা। ইতিহাসের এই একঘেয়ে কথায় বিরক্ত হয়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথও যা লিখেছেন তার সারকথা হল –
ভারতবর্ষের যে ইতিহাস আমরা মুখস্থ করে পরীক্ষা দিই তা ভারতবর্ষের রাত্রির একটি দুঃস্বপ্নের ঘটনা। বাপে- ছেলের, ভাইয়ে ভাইয়ে সিংহাসন নিয়ে মারামারি কাটাকাটি ইত্যাদি। এইভাবে একদল যায় তো আবার একদল উঠে পড়ে। আসে পাঠান-মোগল-পোর্তুগিজ-ফরাসি-ইংরেজ। এসব ছাড়া ইতিহাসে ভারতবাসীর কোনো কথা নেই। কারণ সেই ইতিহাস লিখেছেন তো বিদেশিরা।
প্রকৃত ইতিহাস হল, চিরন্তন স্বদেশকে দেশের ইতিহাসের মধ্যে খুঁজে পাওয়া। অথচ আমরা আমাদের দেশের ইতিহাসের যে বর্ণনা পাই তাতে আমাদের স্বদেশকে ঢাকা দিয়ে রাখা হয়েছে। মামুদের আক্রমণ থেকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী লর্ড কার্জনের গর্বোদ্ধত অত্যাচার সমূহের বর্ণনাই এমনভাবে আমাদের চোখকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে রেখেছে যে আমরা আমাদের পরিচয় খুঁজে পাই না। তাই রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ইতিহাস সকল দেশের সমান নয়। সুতরাং সমস্ত কুসংস্কার বর্জন করে আমাদের নিজেদের ইতিহাস নিজেদেরকে বৈজ্ঞানিক উপায়েই খুঁজে বের করতে হবে।
রবীন্দ্রনাথের আগে সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রও বলে গিয়েছেন, বাঙালির ইতিহাস বাঙালিকেই লিখতে হবে। তাঁর মতে, এতদিন আমরা যে ইতিহাস পড়েছি তাতে আমাদের অতীতকে দেখানো হয়েছে আমাদেরকেই অপরাধী প্রমাণ করে। অনেকটা সেই গল্পে পড়া ঝরনার জল ঘোলা করা ছাগলছানা আর নেকড়ে বাঘের কাহিনির মতো। নেকড়ে ওই ছাগলছানাকে তার পূর্বপুরুষের কৃতকর্মের জন্য আক্রমণ করেছিল। এইভাবে ভারতবর্ষে ব্যাবসা করতে আসা নীলকর সাহেবরা তাদের নিজেদের দেশের প্রয়োজনে এদেশে যান
চাষের পরিবর্তে জোর করে নীলচাষ করিয়ে নিত। নীলচাষ করার জন্য এদেশের গরিব
চাষিদের চড়া সুদে ঋণ দিত। আর সেই সুদ বংশপরম্পরায় নীলচাষ করেই শোধ করতে হত। আর তা শোষ না করালেই তাদের ওপর চলত কঠোর অত্যাচার। কেন যে চাষির ঋণ বেড়ে চলেছে সেই বিচার আর ইতিহাসে বিশ্লেষণ করে দেখানো হল না। অর্থাৎ সহজেই প্রমাণ হয়ে যাচ্ছে যে এখানে প্রকৃত অপরাধী হল এই নেকড়েরূপী অত্যাচারী নীলকর সাহেবরাই। ইতিহাস পড়তে গেলে আমাদের ইতিহাসের ঘটনাবলির বিভাগসম্মত, যুক্তিনিষ্ঠ আলোচনা করেই পড়তে হবে। ইতিহাস থেকেই আমাদের প্রকৃত সত্যের উদ্ঘাটন করতে হবে।
ব্রিটিশরা এদেশে এসেছিল ব্যবসায়ীর ছদ্মবেশে। তারা যুক্তি খাড়া করল, ভারতবাসী অসভ্য। তাই ভারতীয়দের 'সভ্য' করে তুলতে ভারতবর্ষে তারা ব্রিটিশ শাসন কায়েম করল। শিক্ষিত ভারতবাসী একসময় ব্রিটিশদের এই অন্যায়ের প্রতিবাদ জানাল। আমরা ভারতবাসী ব্রিটিশদের অনেক আগে থেকেই অনেক অনেক সুসভা। সম্রাট অশোক থেকে শুরু করে আর্যভট্ট কিংবা শ্রীচৈতন্যের কাহিনিই ভারতের প্রাচীন সভ্যতার সুস্পষ্ট প্রমাণ।
অশোক আর্যভট্ট শ্রীচৈতন্যের কাহিনি জেনেছি আমরা ইতিহাসের পাতা থেকেই। ইতিহাসের পাতাতেই আছে নানান যুক্তিতর্বেদা বিশদে আলোচনা। আছে পক্ষে ও বিপক্ষে যুক্তি। সুতরাং ইতিহাস আমাদের কেন পড়া দরকার তার যুক্তিও এই আলোচনায় স্পষ্ট হবে। গেল।
রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ভারতের ইতিহাস আর ইংল্যান্ডের ইতিহাস এক নয়। তাঁর বক্তব্য হল, ভারতবর্ষের প্রকৃত ইতিহাস খুঁজতে বিদেশিরা ব্যর্থ হয়েছেন। ভারতবর্ষের ইতিহাস লিখতে হবে আমাদেরকেই। ইতিহাসের পাতা ঘেঁটে পক্ষে ও বিপক্ষের যুক্তি প্রতিষ্ঠিত করেই লিখতে হবে আমাদের ইতিহাস। অর্থাৎ সেই নেকড়েরূপী ব্রিটিশ শাসকরা যতই আমাদের পূর্বপুরুষকে অপরাধী সাব্যস্ত করুক না কেন, আমাদেরও যুক্তি দিয়ে বোঝাতে
হবে কেন তাঁরা দোষে জড়িয়ে পড়তে বাধ্য হয়েছিল। বঙ্গিমচন্দ্র স্পষ্ট ভাষাতেই বলেছেন, বিদেশিদের লেখা বাঙালির ইতিহাস ভুলে ভরা। তাঁর মতে, বাঙালির ইতিহাস লিখতে হবে বাঙালিকেই।
এবার প্রশ্ন হল, যে সমাজের অনেক বেশি লোক অশিক্ষিত তারা ইতিহাস রচনা করবেন কীভাবে? যিনি নিজেকে শিক্ষিত ভেবে ইতিহাস লিখছেন তিনিও তাঁরই বিচার অনুযায়ী ইতিহাস লিখছেন। তারা শুধু সিধু কানহ ছাড়া সাঁওতাল বিদ্রোহে অংশগ্রহণকারী মানুষদের কথা কিছুই লিখতে পারেননি। তিনি মহাত্মা গান্দি বা সুভায ব্যতীত ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে প্রাণদানকারী হাজার হাজার মানুষ সম্পর্কে কিছুই জানার প্রয়োজন নেই বলে মনে করেছেন। অর্থাৎ একথাই প্রমাণিত হয় যে, শুধু নিজেদের ইতিহাস নিজেরা লিখলেই সমস্যার সমাধান হয় না। যিনি বা যাঁরা ইতিহাস লিখছেন, তিনি বা তারা কোনো ঘটনা যেভাবে দেখছেন বা বুঝছেন সেভাবেই লিখছেন ইতিহাস। আবার এই একই ঘটনা অন্য কেউ লিখলে তাঁর চোখে দেখা বর্ণনার সঙ্গে পূর্বজনের লেখায় মিল পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ দুজনের দেখার দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন।
বিভিন্ন ব্যক্তির দেখা একই ঘটনার বিবরণ ভিন্ন হয়। ফলে শুরু হয় তর্কবিতর্ক। আর, এই তর্কবিতর্ক হয় বলেই ইতিহাস পড়ে মজা পাওয়া যায়।
> ভারতের ইতিহাসে যুগ বিভাগের সমস্যা ঃঃ
এই যে আমরা ইতিহাস বইটি পড়ছি এটি আধুনিক ভারতের ইতিহাস। এতে আছে পলাশির যুদ্ধ থেকে অর্থাৎ এদেশে ব্রিটিশ শাসনের শুরু থেকে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা লাভ পর্যন্ত আলোচনা। তার আগে ছিল ভারতের মধ্যযুগ। তারও আগে ছিল প্রাচীন যুগ। ২০১৪ সালের তুলনায় অশোকের কলিজা যুদ্ধ অনেক বছর আগের ঘটনা, তাই তা ভারতের প্রাচীন ইতিহাস। আবার পানিপথের যুদ্ধ তুলনামূলকভাবে কলিতা যুদ্ধের অনেকটা পরে ঘটেছে বলে তাকে বলা যায় ভারতের মধ্যযুগের ইতিহাস। আবার পানিপথের যুদ্ধের তুলনায় পলাশির যুদ্ধ ২০১৪ সালের হিসাবে অনেক কাছাকাছি, তাই তাকে বলা যায় আধুনিক ভারতের ইতিহাস |
১৮০৮ খ্রিস্টাব্দে অর্থাৎ ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতেই মৃত্যুর বিদ্যালংকার 'রাজাবলি' নামে ইতিহাস রচনা করতে গিয়ে মহাভারতের যুধিষ্ঠিরের কাল থেকে শুরু করেছিলেন। তিনি রাজাদের কথা বলার জন্যই রাজাবলি শেষ করেছেন 'কলিযুগের ইতিহাস' অর্থাৎ ওই উনিশ শতকের গোড়ায় বসে। কিন্তু আজকের ইতিহাস লেখা হয় অন্যভাবে।
আজকের ইতিহাস লেখা হয় রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ইত্যাদি নানা যুক্তি
হাজির করে। ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে History of British India (হিস্ট্রি অফ ব্রিটিশ
ইন্ডিয়া) নামে একটি ইতিহাস লেখেন জেনস মিল। এ দেশের মানুষদের কীভাবে শাসন
করতে হবে তা বোঝাতে ব্রিটিশ প্রশাসনে নিয়োজিত বিদেশিদের সুবিধার জন্য লেখা
হয়েছিল। এ দেশের অতীতের কথাগুলি একজায়গায় জড়ো করা ইতিহাস।
ঐতিহাসিক জেমস মিল তাঁর লেখা ওই ইতিহাসকে হিন্দু যুগ, মুসলিম যুগ ও ব্রিটিশ যুগ এই তিনটি ভাগে ভাগ করেছিলেন। প্রথম দুটো পর্যায় শাসকদের ধর্মের নামে অর্থাৎ হিন্দু যুগ ও মুসলিম যুগ এই পর্যায় ভাগ করে। আর শেষের পর্যায়টি লিখলেন খ্রিস্টান যুগ বা ধর্মের নামে নয়, জাতের নামে অর্থাৎ ব্রিটিশ যুগ। জেমস মিল তাঁর ইতিহাসে - হিন্দুযুগকে একটা অশ্রদ্ধার ভাব দেখিয়েছেন, মুসলমান যুগকে অন্ধকারময় যুগ বলে উল্লেখ করেছেন।
জেমস মিল তার ইতিহাসে জৈন ধর্মাবলম্বী চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য বা বৌদধর্মাবলম্বী বিম্বিসারকেও হিন্দুযুগের শাসকদের আওতায় একাকার করে লিখলেন। আবার মোগল সম্রাট আকবরের মতো উদার শাসককেও নিছক ধর্মের গন্ডিতে আটকে দিয়ে লিখলেন ভারতের হিন্দু যুগ, মুসলিম যুগ ও ব্রিটিশ যুগ নামের ইতিহাস। ধীরে ধীরে সেই তিনটি ধাপ বদলে হয়ে গেল প্রাচীন, মধ্য ও আধুনিক।
বছর বছর এই ধাঁচের ইতিহাস চর্চা করার অভ্যাস শুরু হয়ে গেল। যেমন ঔরাজের মারা গেলেন ১৭০৭ খ্রিস্টাব্দে। তাঁর সময়কালকে ধরা হল মধ্যযুগ নামে। আবার ঠিক তার মাত্র পঞ্চাশ বছর পরে অর্থাৎ ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের পলাশির যুদ্ধকে ধরা হল ভারতের আধুনিক যুগ নামে। এই যুক্তিগুলো সবসময় মেনে নেওয়া যায় না।
শাসকদের বিচারে ইতিহাসের যুগ বিভাজন করলেও সমস্যা আরও একটা লেখা ে যেমন আজ থেকে প্রায় হাজার বছর আগে সুলতান ইলতুৎমিসের মেয়ে রাজিয়া নির সিংহাসনে বসেছিলেন। তার পর একেবারে অষ্টাদশ শতকের শেষেও এ দেশে প্রশাসনিক পদে কোনো নারীকে দেখা যায় না। তাহলে নারীর শাসন ক্ষমতার নিরিখে বিচার করালে সুলতান রাজিয়াকে মধ্যযুগের বৃত্তে পড়তে হবে কেন?
সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, প্রাচীন মধ্য আধুনিক পর্বে ভেঙে ভারতের ইতিহাসকে অতিসরলীকরণ করে বোঝার চেষ্টা হয়েছে। যুগ বলতে এক মস্ত বড়ো সময়কে বোঝায়। প্রতিটি যুগের মানুষ ও তার জীবনযাপনের নানারকম বৈশিষ্ট্য থাকে। সেই বৈশিষ্টগুলি রাতারাতি বদল হয়ে যায় না। তাই সবসময় হিসাব কষে মুখ বদলের ধারাকে বিচার করাটা vul.
সময়ের দূরত্ব নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে আছে নানা বিতর্ক। বিতর্ক আছে সামাজিক বিচারেও। অর্থাৎ যদি প্রশ্ন ওঠে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ভারতবর্ষের বিভাজন কি কোনোভাবেই বন্ধ করা সম্ভব ছিল না। এটা তো সামাজিকভাবেই একটা প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন। ফলে দেশভাগ বিষয়ে ইতিহাস লিখতে গেলে খুব নির্লিপ্তভাবে লেখা কঠিন সমস্যা। কারণ এরকম ক্ষেত্রে ইতিহাসের বিশ্লেষণে প্রায়শই ঐতিহাসিকদের ব্যক্তিগত মতামত প্রাধান্য পাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল হয়। ইতিহাসের সময় যত দূরের হয়, সেই সম্ভাবনা তত কম ঘটে।
• ভারতের আধুনিককালের ইতিহাসের উপাদান
সমগ্র পৃথিবী জুড়েই আজ আধুনিক যুগের ইতিহাস লেখার অজস্র উপাদান পাওয়া যায়। নানা বৈজ্ঞানিক উপায়ে গত চার-পাঁচশো বছরের পুরোনো উপাদানগুলি, যা প্রশাসনিক কাগজপত্র, বই, আঁকা ছি ডায়রি, চিঠিপত্র, মানচিত্র, পোস্টার, বিজ্ঞাপন, জমি বিক্রিত দলিল, রোজকার বাজারের ফর্ম, সংবাদপত্র ইত্যাদি সযত্নে রক্ষিত আছে। তবে উপাদানগুলি ব্যবহার করার সময় সতর্কতা অবলম্বন করা দরকার।
ধরা যাক, কারও আত্মজীবনী থেকে তাঁর সময়ের ইতিহাসের উপাদান পাওয়া যাচ্ছে। অন্য কেউ যদি সেই আত্মজীবনীর বক্তব্য বিচার না করেই পুরোপুরি মেনে নেন। তাহলে বক্তব্য একপেশে হয়ে যাওয়ার ভীষণ সম্ভাবনা থাকে। আবার ভুল সিদ্ধান্তেও পৌঁছে যাওয়া যায়। যেমন উইলিয়াম ওয়েডারবার্ন তাঁর লেখা অ্যালান অক্টোভিয়ান হিউমের জীবনীতে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার কৃতিত্ব হিউমাকেই দিয়েছেন। কিন্তু পরে বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে হিউমের কৃতিত্ব খুব বেশি এতে ছিল না। তাই ইতিহাস নতুন করে লেখার সময় প্রতিটি উপাদানকেই চুলচেরা বিশ্লেষণ করেই লেখা একান্ত প্রয়োজন।
ফোটোগ্রাফ বা ক্যামেরায় তোলা ছবিও ভারত ইতিহাসের আধুনিক পর্বের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক চরিত্র বিশ্লেষণের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। কিন্তু ইতিহাস লেখার সময় এই ছবি দেখেও ভীষণ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। কারণ একই বিষয়ের দুজনের তোলা দুটি ছবি দু'রকম অর্থ বোঝানো যায়। কারণ যিনি ছবিটি তুলেছেন তিনি কোন মুহুর্তের ছবি তুলছেন তাও ভেবে দেখতে হবে। যেমন আমাদের এই পাঠ্যপুস্তকে প্রদত্ত ৯ পৃষ্ঠার যে ছবিটি আমরা দেখছি তা ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দের হরিপুরা কংগ্রেসের অধিবেশনের সময় তোলা একটি ফোটোগ্রাফ। ওই ছবির মুহূর্তটিতেই শুধু কোনো এক প্রসঙ্গে গান্ধিজি এবং নেতাজির মধ্যে হাসা পরিহাসের দৃশ্যটি ফুটে উঠেছে। অথচ ওই সময়ে উভয়ের মধ্যে নানা প্রসঙ্গে যে যথেষ্ট মতবিরোধ ছিল তা ওই ছবি দেখে বোঝা যায় না। সুতরাং ইতিহাস সবটুকু পড়ে, ফোটোগ্রাফ তোলার মুহূর্ত বিচার করে কিংবা ফোটোগ্রাফারের দৃষ্টিভঙ্গি বিচার করেই নতুন ইতিহাস লিখতে হয়।
প্রশাসনিক নথিপত্রেও দেখার পার্থক্য বিরাট হয়ে দাঁড়ায়। যেমন ব্রিটিশ শাসকদের চোখে তিতুমির, বীরসা মুণ্ডা, সিধু-কানহু-রা হাঙ্গামাকারী হলেও ভারতে ঔপনিবেশিক শক্তিবিরোধী আন্দোলনের মানদণ্ডে বিচার করলে স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসেবেই তাদের সম্মানিত হওয়া উচিত।
নতুন করে ইতিহাস লিখতে গেলে দেখার ও বোঝার দৃষ্টিভঙ্গি নিরপেক্ষ হতে হবে। বুঝতে হবে যে, সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থ উপনিবেশ বিস্তারের এবং জাতীয়তাবাদের ক্ষেত্রে তা আদর্শের। সাম্রাজ্যবাদ তাকেই বলা হয় যখন শক্তিমান দেশ অপেক্ষাকৃত দুর্বল দেশের ওপর প্রভুত্ব বিস্তার করে। তাই শক্তিমান দেশের ঐতিহাসিক যখন ইতিহাস লিখতে বসবেন তিনি দুর্বল দেশের দুর্বলতা খুঁজতে বসবেন। তাঁর মতে, দুর্বল দেশ শুধু দুর্বলই নয়, তারা অসভ্যও। তাঁর মতে, ইতিহাস শুধু সভ্য মানুষের হয়, অসভ্যদের হয় না। তাই দুর্বল দেশকে সভ্য করে তুলতেই সভ্য দেশ দুর্বল দেশের শাসন ক্ষমতা দখল করেছে।
সাম্রাজ্যবাদ এবং উপনিবেশবাদ উভয়েই হাত ধরাধরি করে এগিয়ে চলে। একটি অঞ্চলের জনগণ ও সম্পদকে অন্য একটি অঞ্চলের স্বার্থে ব্যবহার করাটাই উপনিবেশের মূল কথা। একসময় সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটেনের উপনিবেশ হিসেবে ভারতের কৃষিজ ফসল ব্রিটেনের স্বার্থে উৎপাদিত হয়েছিল। ইংল্যান্ডের কাপড়ের কলে নীলের চাহিদা মাথায় রেখে বাংলায় ধান, পাট ইত্যাদি চাষ বন্ধ করে বলপূর্বক নীলচাষ করানো হত।
একসময় জেমস মিল সাহেবের ইতিহাসকে এদেশের শিক্ষিত জনগণ অস্বীকার করে ভারতের প্রাচীন যুগের কথা ও মধ্যযুগের কথা খুঁজতে লাগলেন। তাঁরা নতুন করে যে ইতিহাস লিখলেন তাতে ধরা পড়ল সাম্রাজ্যের স্বার্থের উলটো দিকে স্বদেশের চিন্তা। ইতিহাসের মধ্যে স্থান নিল সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে দেশীয় তথা জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের চুলচেরা বিচার।
ব্রিটিশ ঐতিহাসিক লিখেছিলেন, সিরাজ উদ-দৌলা নিরীহ ব্রিটিশ কর্মচারীদের হত্যা করেছিলেন অন্ধকূপে বন্দি কারে। কিন্তু ভারতীয় ঐতিহাসিক অঙ্ক কষে যুক্তি দিয়ে সেই অপবাদটি মিথ্যা বলে প্রমাণ করে দিলেন।
আমরা এই যে ইতিহাস পড়ছি, এই বইতে আলোচিত হয়েছে প্রায় ২৫০ বছরের কালপর্বে কীভাবে বদল হয়ে গেল ভারতবর্ষের সমাজ, রাজনীতি, সংস্কৃতি ও মানুষের জীবনযাত্রার চরিত্র। এই বই থেকেই ধীরে ধীরে বোঝা যাবে ভারতের ইতিহাস যেন আর দূরে থাকছে না। বর্তমানকে গভীরভাবে স্পর্শ করেছে। পরিবারের একটু বয়স্করাও এই ইতিহাসের আয়নায় নিজেদের মুখ দেখতে পাবেন।
এর পরেও প্রশ্ন নিশ্চয়ই আসবে, কেন পড়ব এই ইতিহাস ? কেন জানব পুরোনো দিনের কথা? এই প্রশ্নের উত্তর জানতে গেলে প্রথমে বুঝতে হবে কী কারণে ভারতবাসীর আত্মীয়রা আজ পর হয়ে গেল। বুঝতে হবে স্বাধীন ভারতবর্ষের প্রতিবেশী স্বাধীন রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে দুটি রাষ্ট্রই একসময়ে ভারতের পরমাত্মীয় ছিল। অথচ তারা কী কারণে আজ পরস্পরের দূরে চলে গেল? আমাদের এই সমগ্র ইতিহাস জুড়েই আছে এই কবে, কীভাবে এবং কেন বিষয়ে আলোচনা।
পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদের নির্দেশ অনুসারে প্রথম অধ্যায়ে কোনো অনুশীলনী নেই। তাই পাঠ মূল্যায়নের সময় এই অধ্যায় থেকে কোনো প্রশ্ন রাখা হবে না। শিক্ষার্থীর প্রশ্নোত্তর শেখার এবং অভ্যাসের জন্য ওপরে কিছু প্রশ্নোত্তর সংক্ষেপে আলোচনা করা।
এই অধ্যায়ের সমস্ত অংশটাই অষ্টম শ্রেণীর পড়ার সাথী বই থেকে নেওয়া হয়েছে। ওই বইটিতে সমস্ত কিছু খুব সহজ সরল ভাষায় ব্যাখ্যা করা হয়েছে। বলছি তোমরা অবশ্যই বই টি কিনে নিও।